নওগাঁ প্রতিনিধি : চারিদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা বিশাল এক মাটির বাড়ি। আঙিনাসহ বাড়ির চারপাশে রয়েছে ২০০ প্রজাতির ফল, ফুল ও ওষুধি গাছ। আঙিনার সঙ্গে এক একর আয়তনের একটি পুকুর। এতে চলছে মাছের চাষ। কৃষকদের হাতে-কলমে শেখানোর আয়োজন করে রাখা হয়েছে এখানে। বাড়ির চালার সঙ্গে ঝুলানো রয়েছে গরুর গাড়ির চাকা, ছই, জমিতে সেচ দেওয়ার জোতসহ কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।
মাটির বাড়িটির পূর্ব-দক্ষিণ কোণের ঘরে রয়েছে বিশাল লাইব্রেরি। সাত হাজারেরও বেশি বই-পুস্তক ও ম্যাগাজিন রয়েছে এখানে। বাইরে বারান্দায় মাথার ওপরে টাঙানো সারা দেশের বিভিন্ন ধরণের কৃষি যন্ত্রপাতি। যাদুঘর কর্নারে রয়েছে বিভিন্ন মডেলের মাথালের সারি আর কৃষি কাজের নানা উপকরণ। এছাড়া অতীত ঐতিহ্যের ধারক পালকি, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, ঢেঁকি, আম পাড়ার জালি, লাঙল, জোয়াল, মাছ ধরার চাঁই থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ঢংয়ের কৃষি উপকরণে ঠাসা যাদুঘরটি।
যাদুঘরের বাইরে বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে লাগানো রয়েছে বিরল প্রজাতির ‘বুদুম’ বাঁশ। সুদুর চট্টগ্রাম বন গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে কঞ্চি কলম সংগ্রহ করে বাঁশের এ জাতটি তৈরি করা হয়েছে। তিন বছরের পরিচর্যায় এখন বাঁশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩টি। আগামিতে এ জাতটি কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
নিভৃত পল্লীতে কৃষকদের জাগিয়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম শাহ ২০০৮ সালে কৃষিতথ্য ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে নিজের বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ সংরক্ষণ করেন বসতবাড়ির পশ্চিমভিটার ঘরে। আশপাশ থেকেও একটু একটু করে সংগ্রহ শুরু করেন কৃষি যন্ত্রপাতি। একসময় তা নেশায় পরিণত হয়। এরপর এলাকা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহিত উপকরণ যোগ হতে থাকে সংগ্রহশালায়।
নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মান্দা উপজেলা থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কালিগ্রামে পৈত্রিক মাটির বাড়িতে জাহাঙ্গীর আলম শাহ তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এই কৃষি যাদুঘর।
কৃষিতথ্য পাঠাগার ও যাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম শাহ বলেন, নিজের প্রয়োজনে ২০০৮ সালে পৈত্রিক মাটির বাড়িতে কৃষির ওপর লেখা বিভিন্ন ধরণের বই সংগ্রহ শুরু করি। এক সময় উপলব্ধি করি এলাকার চাষিদেরও কৃষিকাজে দক্ষতা বৃদ্ধি ও পরামর্শ প্রয়োজন। এ চেতনাবোধ থেকে লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নজর দেই। লাইব্রেরি সমৃদ্ধ হলে কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসে।
জাহাঙ্গীর আলম শাহ আরও বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এ যাদুঘর। বাস্তবজীবনের কৃষকদের সহায়ক বই-পুস্তক, লিফলেট, ম্যাগাজিনসহ স্থানীয় প্রশাসন, চিকিৎসা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ফোন নম্বর রাখা হয়েছে এখানে। এছাড়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে কৃষকদের উপকারী পোকা চেনানো, কৃষিবিষয়ক নানা তথ্য উপস্থাপনসহ পাঠাগারের পক্ষ থেকে সন্ধ্যাবেলায় নিরক্ষর কৃষকদের স্বাক্ষরতা শেখানো হয়।
তিনি আরও বলেন, যাদুঘরটি ৫০টি কর্নারে ও লাইব্রেরি ৭০টি কর্ণারে বিভক্ত করা হয়েছে। ছবি কর্নারে রয়েছে কৃষিকাজে অবদান রেখেছেন দেশি-বিদেশি এমন ৪০ জন গুণীব্যক্তির ছবি সম্বলিত নাম ও পরিচয়। কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধু মানুষের কল্যাণে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি। আগামিতে এ জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধি করার চিন্তা রয়েছে।
এ যাদুঘরে বিভিন্ন ধরণের নিড়ানী, হারিকেন, কুপিবাতি সাজানো রয়েছে থরে থরে। সারির পর সারিতে টাঙানো শাবল, বেলচা, খুন্তা, ওয়াসার, লাফনা ইত্যাদি। রয়েছে কাঠ কাটার জন্য বিভিন্ন ধরণের করাত ও কাস্তের সামাহার। মাটির ঢ্যালা ভাঙার বিভিন্ন ধরণের হাতুড়ি, লাঙল, ধান ও তেল মাপার পরিমাপক-নিক্তি, কাঠা ও বাঁশের চোঙ। এছাড়া আছে হাতেটানা প্রাচীন পাখা যা এখনও সচল।
লাইব্রেরির ভেতরে কৃষকের স্বাস্থ্য শিক্ষা, চাষাবাদের জন্য থরে থরে সাজানো দুর্লভ বই। এখানে কৃষিবিষয়ক বই, পুস্তক, লিফলেট, ম্যাগাজিন ছাড়াও বাস্তবজীবনে কৃষকদের প্রয়োজন এমন সব বিষয়ের অনেক বই রয়েছে। এখানে কুল চাষে করণীয়, বীজ উৎপাদনের কৌশল, ফসলের মাঠ নিয়ে চিত্রাঙ্কণ প্রতিযোগিতা, ওল বীজ বিতরণ ও প্রশিক্ষণ, কলেজ পর্যায়ে বই বিতরণ ভেজাল সার চেনার উপায় নিয়ে কর্মশালা করা হয়।
সেই সঙ্গে জাতীয় কৃষি দিবসে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য ভালো কৃষক, ভালো হালচাষি, ভালো শ্রমিক, ভালো বীজ প্রস্তুতকারক, ভালো কীটনাশক ছিটানোসহ ১৩টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
জানা গেছে কৃষিকাজে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ এ ভূষিত হন জাহাঙ্গীর আলম শাহ্। এছাড়া একাধিকবার বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। চলতি বছরের ২ এপ্রিল বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘দীপ্ত টিভি’ এর পক্ষ থেকে কৃষি শিক্ষা বিষয়ে অ্যাওয়ার্ড প্রদানসহ একলাখ টাকা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
যাদুঘরটি পরিদর্শনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই আসছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরিদর্শন বইয়ে একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘অবাক হয়ে দেখলাম। অসাধারণ। একজন সাধারণ মানুষের অসাধারণ কীর্তি। চোখে না দেখলে বোঝা মুশকিল। কী সুচিন্তিত এ পরিকল্পনা। কী নেই এখানে। প্রবল ইচ্ছাশক্তিই পারে অসম্ভবকে এভাবে সম্ভব করতে।’ দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. সদরুল আমিন।
লিখেছেন, ‘যা শুনেছি ও দেখেছি এখানে পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি।’ এ ধরণের অসংখ্যা মন্তব্য, যা সত্যিই অবাক করার মতো।
এ প্রসঙ্গে মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শায়লা শারমিন বলেন, এটি অসম্ভব ভালো লাগার একটি কৃষি যাদুঘর। যান্ত্রিকীকরণের ভিড়ে বিলুপ্ত প্রায় কৃষি যন্ত্রপাতি এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কৃষির প্রাচীন ঐতিহ্যকে পরিচিত করতে যাদুঘরটি সহায়ক হিসেবে কাজে লাগবে।
তিনি আরও বলেন, যাদুঘরের পাশেই রয়েছে বিশাল লাইব্রেরি। এলাকার কৃষকরা লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ে উপকৃত হচ্ছেন। গবেষণার কাজেও শিক্ষার্থীদের কাজে লাগবে যাদুঘর ও লাইব্রেরি। একক প্রচেষ্টায় গ্রামাঞ্চলে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটি মান্দাবাসির সম্পদ বলেও উল্লেখ করেন এ কৃষি কর্মকর্তা।
আরবিসি/০৫ জুন/ রোজি