আরবিসি ডেস্ক : ৮ ফেব্রুয়ারি, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক উৎকণ্ঠার দিন। ২০১৮ সালের এই দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দু’বারের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে কারান্তরীণ করা হয়েছিল। ওইদিন জিয়া অরফারেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান এক রায়ে বেগম জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। রায়ের পরই সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নেয়া হয়। আজ ৮ ফেব্রুয়ারি, খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশের ৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। দিনটিকে ঘিরে কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা ও মহানগরে প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
বেগম জিয়ার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এটাই প্রথম কারাবাস নয়। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি রাজনীতিতে যোগদানের পর তিনি বিভিন্ন সময়ে চারবার গ্রেফতার হন। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। ওই তিনবারই তাঁকে বেশিদিন কারান্তরীণ থাকতে হয়নি। এরপর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হয়ে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ সাব-জেলে এক বছরেরও (৩৭২ দিন) বেশি সময় বন্দি ছিলেন বেগম জিয়া।
এর প্রায় এক দশক পর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফারেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিশেষ আদালতের রায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়ার কারাবাস শুরু হয়। এক বছরেরও বেশি সময় নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবন অতিবাহিত হয় তাঁর। এরপর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য তাঁকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কেবিন ব্লকের প্রিজন সেলে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফারেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার পর প্রথম এক বছরে অন্যান্য মামলায় হাজিরার জন্য বিভিন্ন সময়ে বেগম জিয়াকে ৯ বার আদালতে হাজির করা হয়। এর মধ্যে নাইকো দুর্নীতি মামলায় হাজিরার জন্য পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে ৭ বার এবং গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় হাজিরার জন্য বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার-৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে ২ বার হাজির করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে।
কারাবাসের প্রথম বছরে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য তিনবার বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নেয়া হয়। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল, একই বছরের ৬ অক্টোবর এবং ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল তাঁকে হাসপাতালে নেয়া হয়। আগের দু’বার হাসপাতাল থেকে কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হলেও শেষবার অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে পরবর্তী প্রায় ১১ মাস বিএসএমএমইউ হাসপাতালে কারা নজরদারিতে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া।
এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১ ধারা অনুযায়ী বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকারের নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে ৬ মাসের জন্য বেগম জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়। শর্ত অনুযায়ী, মুক্ত থাকাকালীন খালেদা জিয়াকে নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। ওই সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
২ বছর ১ মাস ১৯ দিন বন্দিদশায় থাকার পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে ৬ মাসের অন্তর্র্বতীকালীন মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় যান খালেদা জিয়া। গেল বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর মুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই শর্ত অপরিবর্তিত রেখে সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধি করে। শর্তসাপেক্ষে পাওয়া সেই মুক্তি নিয়ে গত প্রায় ১১ মাস ধরে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় থেকেই চিকিৎসাধীন আছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
৫ বছরের সাজা দ্বিগুণ হলো যেভাবে:
জিয়া অরফারেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সাজা দিয়েছিলেন বকশীবকাজারে স্থপিত অস্থায়ী পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত। পরে খালেদা জিয়া খালাস চেয়ে এ সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষ বেগম জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে আবেদন করে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এ মামলায় বেগম জিয়ার সাজা ৫ বছর বাড়িয়ে ১০ বছরের আদশে দেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
অপরদিকে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বেগম জিয়াকে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত ঢাকার ৫ নম্বর অস্থায়ী বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান এর আদালত। একইসঙ্গে তাঁকে ১০ লাখ টাকা জারিমানাও করা হয়। অনাদায়ে কারাদণ্ডাদেশ আরও ৬ মাস বাড়ানোর আদেশ দেন আদালত।
এদিকে বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির পক্ষ থেকে বিগত সময়গুলোতে বিছিন্নভাবে কিছু আন্দোলন ও মানববন্ধন কিংবা প্রতিবাদ কর্মসূচি করা হলেও কার্যত নেত্রীর মুক্তির পথে তা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রতিবারই দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তিতে জোর আন্দোলন, এমনকি সরকার পতনের হুমকি-হুঁশিয়ারি দিয়ে আসলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
আরবিসি/০৮ ফেব্রুয়ারী/ রোজি