• শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

চলে গেলেন ভাষা সংগ্রামী আবুল হোসেন

Reporter Name / ১২৯ Time View
Update : বুধবার, ৩১ মার্চ, ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী মহানগরীর মঠপুকুর শান্তিবাগ এলাকায় রাস্তা সংলগ্ন তিনতলা বাড়িটির নাম সুফিয়া মহল। সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই হাতের ডানের প্রথম ঘরেই থাকতেন ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন। ঘরের ভেতরে খাটে বিছানা তখনো পাতা রয়েছে। উত্তর দেয়ালে নাতি আকাশ ও নাতনি অঙ্কিতার সঙ্গে বাঁধানো ছবি, দক্ষিণ দেয়ালে স্ত্রীর সঙ্গে এবং পূর্ব দেয়ালে ফসলের ক্ষেতের মাঝে সারিবদ্ধ তালগাছের ছবিটিও আগের মতই ঝুলছে। বিছানায় তিনটি বালিশ, পাশেই ব্যবহারের টিস্যু বক্স পড়ে আছে। ঘুরছে সিলিং ফ্যান। মনে হবে, ঘরের বাসিন্দা ক্ষণিকের জন্য বাইরে গেছেন, এক্ষুনি ফিরবেন। কিন্তু না তিনি ঘুমিয়ে আছেন বাড়ির নিচতলার প্রথম ঘরের মেঝেতে। এ ঘুম আর ভাঙবেনা কোনদিন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।

বুধবার (৩১ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে রাজশাহীর ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। দুই ছেলে আবুল হাসনাত ও আবুল আহসান, মেয়ে শাহানারা খাতুন, নাতি-নাতনিসহ তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

মরহুমের বড় ছেলে আবুল হাসনাত জানান, ১০-১৫ দিন থেকে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার আগ পর্যন্ত তিনি নিজেই বাথরুমে যাওয়া, খাওয়া, গোসল সবই করতেন। হঠাৎ করেই তাঁর খাওয়ার রুচি হারিয়ে যায়। তাঁর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। বুধবার সকাল ১০টার দিকে তাঁকে প্রথমে বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে বিকেল ৪টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক বিল্লাল উদ্দিন তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানান, বারিন্দ হাসপাতাল থেকে আসার পর তাঁর ইসিজি করিয়ে দেখা যায় তিনি মৃত।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-১ সরিফুল ইসলাম বাবু তাকে ফোন করেন যে, বেসরকারি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাষাসৈনিক আবুল হোসেনকে রামেক হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। খবর পাওয়ার পর চিকিৎসক প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা গেছেন।
ডা. বিল্লাল উদ্দিন জানান, পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন- ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তার বুকেও ব্যাথা ছিল। এছাড়া বার্ধক্যজনিত অন্যান্য সমস্যাও ছিল। গত ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছিল। অসুস্থ হবার পর তার করোনার পরীক্ষা করা হয়নি।

ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৫২ পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল সব আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও কিছু দিন আগে তিনি রাজশাহীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। গত ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানেও তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন।

ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজশাহীর সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রাজশাহী মহানগরের সভাপতি, নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি নাগরিক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল ভাষাসৈনিক আবুল হোসেনের বাসায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে উপহার দিয়ে আসেন।
এদিকে, সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাশ ৮টা পর্যন্ত নগরীর ভুবনমোহন পার্ক শহীদ মিনারে আবুল হোসেনের লাশ রাখা হয়। এরপর রাত ৯টায় টিকাপাড়া ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

আবুল হোসেনের মৃত্যুতে রাজশাহীর বিভিন্ন অঙ্গণে শোকের ছায়া বিরাজ করছে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। তারা আবুল হোসেনের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তারা বলেছেন, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে ভাষাসৈনিক আবুল হোসেনের যে অবদান তা জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি এবং নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আবদুল খালেক।

রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষে সভাপতি এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন ও সাধারণ সম্পাদক মো. ডাবলু সরকার গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এক শোক বার্তায় নেতৃদ্বয় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

শোকপ্রকাশ করেছে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরইউজে)। শনিবার সন্ধ্যায় আরইউজে সভাপতি রফিকুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক তানজিমুল হক এক শোকবার্তায় বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

এছাড়াও শোক জানিয়েছেন আরইউজে’র সহসভাপতি তৈয়বুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান টুকু, কোষাধ্যক্ষ সরকার দুলাল মাহবুব, সদস্য শরিফুল ইসলাম তোতা ও আনিসুজ্জামান।
আরও শোক জানিয়েছে রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ। বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টায় সংগঠন দুইটির সভাপতি সাইদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আসলাম-উদ-দৌলা যুক্ত বিবৃতিতে এ শোক প্রকাশ করা হয়।

এছাড়াও এক বার্তায় রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি এম ওবাইদুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল বিদ্যুৎ সংগঠনের পক্ষে শোক প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি কমরেড এনামুল হক ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড রাগিব আহসান মুন্না যুক্ত বিবৃতিতে এ শোক প্রকাশ করে বলেন, তাঁর মৃত্যু প্রগতিশীল অঙ্গনে ব্যাপক শূন্যতার সৃষ্টি করলো। আমরা পিতৃতুল্য এক বন্ধুকে হারালাম।

আরবিসি/৩১ মার্চ/ রোজি

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category