• শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ন

ভাষা হিসেবে বাংলা কতটা প্রভাবশালী

Reporter Name / ২০০ Time View
Update : শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

আরবিসি ডেস্ক : ভাষা মনন ও বস্তুজগতে প্রভাবশালী। আমরা মনে ভাব তৈরি করে তা ভাষায় প্রকাশ করি। তবে সেই মনের জগতকে ভাষা নিজেই প্রভাবিত করতে পারে। তাই ব্রিটিশরা উপনিবেশ গুটানোর পরেও তাদের ভাষা ইংরেজির প্রসার এখনো কলোনিগুলাতে উপনিবেশিক প্রভাবের উপস্থিতি হিসেবেই ভাবা হয়। সব ভাষা টিকে থাকে না, কালের গর্ভে হারিয়ে যায়; সাথে হারায় সেই ভাষার মানুষের সংস্কৃতি ও ইতিহাস। পৃথিবীতে ৬,০০০ এরও বেশি কথ‍্য ভাষা থাকলেও কিছু ভাষার ভাষাভাষীর সংখ‍্যা একেবারে কম। প্রায় দুই হাজার ভাষা আছে যা এক হাজার এর চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ বলতে পারে (সুত্র: চেন, “পাওয়ার লেংগুয়েজ ইন্ডেক্স”)। ফেব্রুয়ারি আমাদের গৌরবের মাস; ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ের মাস। আমাদের বিবেচনার সময় এসেছে ভাষা হিসেবে আমাদের বাংলা কতটুকু প্রভাবশালী। ভাষার প্রভাবই বা আমরা কীভাবে নির্ণয় করব? আমরা নিজেদের ভাষা অন্যদের উপরে চাপাতে চাই না; তবে নিজেরা ক্ষয়ে যেতে চাই না।

ভাষার প্রভাব বিভিন্নভাবে পরিমাপ করা যায়। ফ্রান্সের প্রভাবশালী ব্যবসা বিদ্যালয় ইনসিয়াডের ডিস্টিংগুউইশড ফেলো জনাব কাই এল চেন ভাষার প্রভাবের বিভিন্ন মাপকাঠিকে এক জায়গায় করে “পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইন্ডেক্স” বানিয়েছেন। এটা ইন্ডেক্স বা সূচকের আলোকে ভাষার প্রভাব সংখ্যায় প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও সূচকের নিজস্ব কিছু দুর্বলতা রয়েই যায়; তবে চেন সাহেবের সূচক দিয়ে মোটামুটিরকম ভাষার প্রভাবের ধারণা পাওয়া। তা আলোচনা করছি; তার প্রেক্ষিতে বাংলা কেমন আছে এবং কীভাবে সর্বতোভাবে প্রয়োজনীয় কিছু ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাও তুলে ধরছি।

উল্লেখিত সূচকে ভাষার প্রভাবের বলয়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের পরিমাপযোগ্য কিছু মাপকাঠিসহ গুরুত্ব ইনডেক্সে কেমন তার শতকরা ভাগ ব্র‍্যাকেটে উল্লেখ করা হোল। (১) ভুগোল (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে কেমন ভ্রমণ করা যায়? এটা পরিমাপ করা হয়েছে তিনটি সংখ্যা দিয়ে – ‘ভাষা কয়টি দেশে চালু আছে’, ‘ওই দেশগুলোর আয়তন কত’, ‘ওই দেশগুলোতে ইনবাউন্ড বা আগত পরিব্রাজকের সংখ্যা কত’। (২) অর্থনীতি (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কতটুকু অংশগ্রহণ করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু অর্থনীতির মাপজোক আমলে নেয়া হয়েছে; জিডিপি (পিপিপি), মাথা পিছু জিডিপি(পিপিপি), রফতানি, ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট, ‘স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস’ কম্পোজিশন বা ভাষার প্রধান দেশের মুদ্রা আইএমএফ (ইন্টারন‍্যশনাল মনিটারি ফান্ড) এর মুদ্রা সঞ্চয় তহবিলের শতকরা কত ভাগ । (৩) যোগাযোগ (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে আলাপ আলোচনার ব্যপ্তি কেমন? এটা পরিমাপ করা হয়েছে চারভাবে: নেটিভ বা দেশীয় ভাষাভাষীর সংখ্যা, কত মানুষের কাছে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা, পরিবারের গড়পড়তা সদস্য সংখ্যা, এবং আউটবাউন্ড ট্যুরিস্ট বা বাইরে গমনকারী পরিব্রাজকের সংখ্যা। (৪) জ্ঞান ও মিডিয়া (২২.৫%): ভাষা জানলে জ্ঞান আহরণ ও মিডিয়া ব্যবহার কতটুকু করা যায়? এটা মাপা হয়েছে ভাষায় ‘ইন্টারনেট কন্টেন্ট’, ‘ফিচার ফিল্মের সংখ্যা’, ‘প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাষার ব্যবহার’ ও ‘একাডেমিক জার্নালের সংখ্যা’। (৫) কূটনীতি (১০%): ভাষা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কেমন কাজে দেয়? এটা মাপা হয়েছে, “আইএমএফ”, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক”, “ইউনাইটেড নেশন্স” (জাতিসংঘ) ও “প্রথম দশটি বহুজাতিক সংগঠনে” ভাষার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে। এসব মাপজোক এক জায়গায় করে সূচকের মাধ্যমে প্রতিটি ভাষাকে একটা স্কোর দেয়া হয়।

সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে ‘ইংরেজি’। সূচকে উল্লেখিত সব দিক দিয়েই ইংরেজি এগিয়ে আছে। এর পরে ক্রমানুসারে প্রভাবশালী হলো ম্যান্ডারিন, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক, রাশিয়ান, জার্মান, হিন্দি, জাপানিজ ও পর্তুগিজ। বাংলা ৩০তম স্থান পায়। বাংলার উপরে হিন্দি ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার ভাষার মধ্যে আছে তামিল (২৯তম)। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষাভাষী অনেক হওয়ার কারণে বাংলা স্কোর বেশি পায় ভৌগলিকে; সেই স্কোর অনুযায়ী বাংলা ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু বাংলা পিছিয়ে গেছে সূচকের ‘অর্থনৈতিক’, ‘যোগাযোগ’, ‘মিডিয়া’, ও কূটনীতি’’ দিক থেকে। কুটনীতির ক্ষেত্রে অবশ্য প্রথম কয়েকটি ভাষা ছাড়া (যেমন, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ প্রথম স্থানে; স্প্যানিশ দ্বিতীয়; অ্যারাবিক তৃতীয়; রাশিয়ান পঞ্চম, ম্যান্ডারিন ষষ্ট, জাপানিজ সপ্তম, ও রাশিয়ান অষ্টম) বাকীদের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই। তবে সূচকের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষাগুলোর স্তর বিন্যাস ও দূরত্ব আছে বেশ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলা ৭৩ স্থানে – বেশ দুঃখের বিষয়; আরো পরিতাপের বিষয় হলো ‘জ্ঞান ও মিডিয়ার’ ক্ষেত্রে বাংলা ৩৬তম অবস্থানে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে ২৬তম আছে বাংলা। এই সূচকে অর্থনীতির উন্নতির উপরে বেশ জোর দেওয়ার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে বাংলা কম স্কোর পেয়েছে। দেশ এগিয়ে গেলে এবং আয়ের বৈষম্য কমে আসলে বাংলা এগিয়ে যাবে – তা সময়সাপেক্ষ একটা ব্যপার। তবে আমি মনে করি, জ্ঞান ও মিডিয়ার ক্ষেত্রে বাংলা পিছিয়ে থাকা আমাদের স্বল্প, দীর্ঘ – উভয় মেয়াদের খামখেয়ালীর বহিঃপ্রকাশ। এক্ষেত্রে যথেষ্ঠ উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ আছে; সেটা বিশ্বায়নের সাথে বাংলাকে দূরে রেখে নয়। নিম্নে এরকম কিছু বিষয় ও তাদের নায্যতা তুলে ধরলাম।

বহুভাষা এক বিশেষ দক্ষতা: বিজ্ঞান বলে, বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা ব‍্যক্তির বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি করে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে বিভিন্ন ব‍্যপ্তিতে বাংলা ও ইংরেজি উভয়েরই প্রচলন আছে। কিন্তু অনেক বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট স্তরে এসে দেখা যায় বাংলার গুরুত্ব কমে যায়। ফলে শিক্ষার্থীদের বাংলার প্রায়োগিক দক্ষতা কমে আসে। এক্ষেত্রে, আন্ডারগ্রাজুয়েট (পাস ও অনার্স) স্তরে ন‍্যুনতম বাংলা দক্ষতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র ইংরেজি নয়, বাংলায় ভালো দক্ষতা সরকারি বেসরকারি উভয় কাজের ক্ষেত্রেই ব‍্যক্তিকে উন্নত মানব সম্পদে পরিণত করতে পারে। এক ভাষায় অর্জিত দক্ষতা যে অন‍্য ভাষায় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে – এ বিষয়ে সর্বব‍্যপী আলোচনা ও জাগরণ দরকার।

বাংলায় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট: গণ‍্যমান‍্য ব‍্যক্তিরা অনেকেই আজ সামাজিক মাধ্যমে বাংলায় লিখছেন। তা বাংলায় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা ডাটা উৎপাদন করতে বেশ সহায়তা করছে। দেশীয় বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ওয়েব কন্টেন্ট বাংলায় রাখতে উৎসাহিত করা উচিত। তাছাড়া বাংলায় লেখা বিভিন্ন আর্কাইভ ও ঐতিহাসিক দলিল, ডকুমেন্টস ইত্যাদি মেশিন রিডেবল করে ওয়েবে ছেড়ে দেয়া যায়।

ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ ও কম্পুটেশনাল সমাজ বিজ্ঞান: আগে হিউম্যানিটিজ বা মানবিক বিষয় সংক্রান্ত গবেষণায় গবেষক নিজে পড়ে ইন্টারপ্রেটিভ আলোচনা করার একটা প্রধান আংগিক ছিল। তবে আজকাল কম্পিউটার একসাথে অনেক লেখা কম সময়ে বিশ্লেষণ করতে পারে। শুধুমাত্র লেখা নয়, ভাব প্রকাশের অন‍্যান‍্য মাধ্যম, যেমন, অডিও এবং ভিডিও মাধ্যমের প্রকাশভঙ্গি কম্পিউটারে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে প‍্যটার্ন বের করা যায়। এভাবে, কম্পিউটার ভিত্তিক, মানবিক আঙ্গিকে প্রকাশের বিশ্লেষণ “ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ” নামক আলাদা একাডেমিক ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরাও কিন্তু মানুষ ও সমাজের আচরণ বুঝতে অনেক বেশি ডাটা কম সময়ে, আরো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের জন্য মেশিন রিডেবল ডাটা ও ডকুমেন্টস কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করছেন – এটাকে নতুন একাডেমিক ফিল্ডে ভাবা হচ্ছে যার সংক্ষেপ হলো “কম্পিউটেশনাল সোশ্যাল সায়েন্স”। এসব নতুন একাডেমিক ক্ষেত্রে গবেষকের থাকতে হবে বহুমুখী জ্ঞান ও পদ্ধতিগত দক্ষতা: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, প্রেক্ষাপট, এবং সামাজিক আচরণ। লাইব্রেরিয়ানরাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তাদেরকেও এই নতুন নতুন ক্ষেত্রে গবেষকদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই, বাংলায় তৈরি হওয়া ডিজিটাল ডেটা ব‍্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণের সুযোগ পাবে; বাংলা এগিয়ে যাবে, সাথে আগাবে মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার।

একাডেমিক জার্নাল বাংলায়: প্রাইভেট সেক্টরের সক্রিয় ভুমিকায় বাংলাদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ঢালাওভাবে সমালোচনা করেন। তবে তারা ভুলে যান এক বিশাল অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এখন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণিদের দায়িত্ব সক্রিয় সহায়তা করে মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। প্রাইভেট ও সরকারি সব উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাজের জন‍্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান তৈরিতে পড়ানোর পাশাপাশি জার্নাল প্রকাশের জন‍্য সরাসরি বেতন ও কাজের সময় ভিত্তিক প্রণোদনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলায় জার্নাল প্রকাশ করা উৎসাহিত করা যায়। এতে শিক্ষকেরা তাদের নিজ নিজ বিষয়ে বাংলায় আলোচনা ও লেখায় উৎসাহী হবেন। তবে ফলপ্রসূ হওয়ার জন‍্য শিক্ষকের সংখ্যা বাড়িয়ে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত কমাতে হবে, শিক্ষকের পাঠদানের সময় কমাতে হবে।

ভাষা গতিময়। তার নিজের প্রকাশের সীমানা আছে। তবে, ব‍্যপক ব‍্যবহার ভাষার সীমানাকে প্রসারিত করবে, নতুন গতির সঞ্চার করবে। আসুন, ভাষার মাসে শপথ নেই বাংলার নিয়মিত ব‍্যবহারের। বাংলা ভাষাভাষীদের প্রচার ও প্রসার বিভিন্ন জাগতিক জ্ঞানেরও উৎকর্ষ সাধন করবে।

আরবিসি/০৬ ফেব্রুয়ারী/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category