বিশেষ প্রতিবেদক : চিরসবুজের দেশ বাংলাদেশ। সবুজের বুক চিড়ে এ দেশে বয়ে চলেছে শত শত নদ-নদী। শুধু কি নদ-নদীই! দেশের বুকে জন্মেছে হাজারো প্রজাতির গাছ, শোভিত করেছে পরিবেশ পাশাপাশি সাড়িবদ্ধভাবে গাছ লাগানো বহু রাস্তা। আর চিরসবুজ এই দেশে এমন কিছু রাস্তা রয়েছে, যে রাস্তা ধরে হাঁটলেই গাইতে ইচ্ছে করে…’এই পথ যদি না শেষ হয়/তবে কেমন হতো বলো তো…’।
তেমনই একটি চোখ ধাঁধানো রাস্তা ‘প্যারিস রোড’। নামটি শুনলেই স্বপ্নের মতো মনে হয়। কল্পনায় ফুটে ওঠে ফ্রান্সের কোনো এক রাস্তা। অবশ্য রাস্তাটি দেখলেও তাই মনে হবে। কিন্তু না। রাস্তাটি অবস্থিত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তার সঙ্গে অনেকটাই মিল থাকায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে এটি ‘প্যারিস রোড’ হিসেবেই পরিচিত। শুধু রাবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছেই নয়, সৌন্দর্যের কারণে রাস্তাটি সারা দেশের মানুষের কাছেই দর্শনীয়।
রাস্তাটির দুই ধারে বেড়ে উঠেছে সুউচ্চ গগনশিরীষ গাছ। পিচঢালা পরিষ্কার রাস্তার এক ধারের গাছগুলো যেন আরেক ধারের গাছগুলোর সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চায়। বাহারি ডালে সজ্জিত সবুজ কচি পাতাগুলোর মেলবন্ধনে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দেয় সূর্যের ঝলমল আলো। সেই আলো আবার কচি পাতাগুলোকে ভেদ করে রাস্তায় ঠিকরে পড়ছে। বাতাসের দোলাতে আলোকছটাগুলো রাস্তায় যেন দোল খাচ্ছে। ঝিলিমিলি করছে পিচঢালা রাস্তা। সব মিলিয়ে আলো-ছায়ার প্রতিনিয়তই খেলা চলে এই রাস্তায়। যা আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমী হাজারো মানুষকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই সুন্দর এই রাস্তাটি মুহূর্তেই নজর কেড়ে নেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত চলে গেছে রাস্তাটি। দুই পাশের এই আকাশচুম্বী গাছগুলো কেবল সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, লালন করে ক্যাম্পাসের বহু ইতিহাস আর ঐতিহ্য।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় প্রশাসন। তৎকালীন উপাচার্য এম শামসুল হক ফিলিপাইন থেকে কিছু গগনশিরীষ গাছ নিয়ে আসেন। তিনি এই গাছগুলো রোপণের দায়িত্ব দেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে। তার হাত ধরেই ক্যাম্পাসের কাজলা গেট থেকে শের-ই-বাংলা হল পর্যন্ত এই গগনশিরীষ গাছগুলো লাগানো হয়। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে রাবির ক্যাম্পাসে রোপণ করা কিছু চারা যে মহিরুহে পরিণত হবে তা হয়তো ভাবেনি কেউ।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদচারণে সকাল-সন্ধ্যা সরব থাকে এই রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে ইট-পাথরে নির্মিত বেঞ্চ আর ঘাসে বসে চলে গান আর আড্ডা। নানা দিবস, অনুষ্ঠান আর র্যাগ ডে-তে মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত থাকেন শিক্ষার্থীরা। সকাল এবং বিকেলবেলায় হাঁটার জন্য এ রাস্তাই থাকে সবার পছন্দের শীর্ষে।
প্যারিস রোড নিয়ে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর সাথে। তারা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসার পর সবচেয়ে বেশি মিস করি প্যারিস রোডে বিকেলের হাঁটাহাঁটির মুহূর্তগুলো। প্রাণের ক্যাম্পাসে কখনো গেলে এ রাস্তায় একটু হলেও হেঁটে আসি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের স্মৃতিগুলো হৃদয়ে গাঁথা থাকবে আজীবন।’
বড় ভাইয়ের থেকে প্যারিস রোডের কথা জানতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আছিয়া খাতুন। তিনি বলেন, বড় ভাইয়ের মুখেই প্রথম শুনেছি প্যারিস রোডের কথা ২০১৭ সালে। তখন থেকেই মনে হতো কবে যাব, কবে হাঁটবো সেই রাস্তায়। বাস্তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে প্রিয় ক্যাম্পাসের এই রাস্তায় হাঁটা হয়। যেটা অনেক বড় প্রাপ্তি।
বাইরে থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বেড়াতে আসেন অনেকে। বিমোহিত হন প্যারিস রোডের সৌন্দর্যে। এমনই এক দর্শনার্থী ঠাকুরগাঁও এর লিমন ইসলাম বলেন, রাবি অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা ক্যাম্পাস। স্থাপনা গুলোর অবকাঠামো চোখে পড়ার মতো। তবে প্যারিস রোডের সৌন্দর্য্য সবাইকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা এটি।
রাস্তাটির নামকরণের বিষয়ে জানতে চাইলে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. গোলাম কবীর বলেন, দেশের অন্য কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে এমন সুউচ্চ গাছের দৃষ্টিনন্দন বিন্যাস আর নেই। সে কারণেই এটি দেশের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এই রাস্তার নামকরণ করেনি। এই রাস্তাটির সঙ্গে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের রাস্তাগুলোর অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এটির নাম দেন ‘প্যারিস রোড’। সেই থেকে রাস্তাটি প্যারিস রোড নামে পরিচিতি লাভ করে।
আরবিসি/১৩ মার্চ/ রোজি