• সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ পূর্বাহ্ন

দৈনিক চাঁদা আদায় ২০ লাখ, ভাগ পায় কারা?

Reporter Name / ১৬০ Time View
Update : রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২

আরবিসি ডেস্ক : পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও লাইনম্যানদের নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর নিউমার্কেটের ফুটপাত। প্রতিদিন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয় একজনকে। প্রতিদিন চাঁদা আদায় হয় কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা। হকার, হকার্স লীগের নেতা ও গবেষকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পেয়েছে সময় সংবাদ। চাঁদা তোলার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন লাইনম্যানের নামও এসেছে সময় সংবাদের অনুসন্ধানে।

লাহেদুল ইসলাম। টঙ্গী সরকারি কলেজের এই শিক্ষার্থী ভ্যানে করে জুতা স্যান্ডেল বিক্রি করতে প্রথমবারের মতো এসেছেন ঢাকার নিউমার্কেট ফুটপাতে। এক নম্বর গেটে প্রথম বাধার মুখে পড়েন তিনি। সাদা টি-শার্ট পরা এক ব্যক্তি লাহেদুলকে জানান, এখানে চাইলেই কেউ দোকান নিয়ে বসতে পারেন না। আছে নিয়মকানুন।

এখান থেকে সরে গিয়ে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের সামনে গিয়ে দোকান বসানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ লাহেদুল। ভ্যান এগিয়ে ঢাকা কলেজের সামনে গিয়েও আরেকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে গিয়ে বাধার মুখে ট্রাফিক পুলিশের।

এবার ভ্যান ঘুরিয়ে নূরজাহান শপিং সেন্টার হয়ে বলাকা সিনেওয়ার্ল্ড কোথাও জায়গা না পেয়ে এলাকা ছাড়েন হতাশ লাহেদুল। তিনি বলেন, এখানে নাকি কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে সরাসরি দোকান খুলে বসা যায় না।

নিউমার্কেটের ফুটপাতে দীর্ঘদিন হকারি করেন এমন একজনের সঙ্গে কথা হয় সময় সংবাদের। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি তুলে ধরেন চাঁদাবাজির বিস্তারিত।

তিনি বলেন, লাইন ভাড়া ৫০০ টাকা। ব্যাগের দোকান ৪০০ টাকা। ওই পাশে তো ডাকাত। দেড় থেকে দুই হাজার, যার কাছ থেকে যা নিতে পারে। টাকাগুলো ভাগ হওয়ার ক্ষেত্রে টিআই স্যার আছেন, তারপর তদন্ত আছে, ওসি আছেন, ফাঁড়ির সার্জেন্ট আছেন, এসআই আছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছেই টাকার ভাগ যায়। থানার স্পেশাল গাড়ি আছে। তাদেরও জন্য টাকার বরাদ্দ আছে।

তার কথার সত্যতা পাওয়া গেল আরও কয়েকজন হকারের সঙ্গে কথা বলে। তারা জানান, লাইন চার্জ ৫৫০ টাকা। এক হাজার টাকার মতো খরচ পড়ে।

ফুটপাত থেকে এবার নিউমার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করা যাক। এখানকার বেশির ভাগ দোকান মালিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে তাদের সামনের ফাঁকা জায়গা ভাড়া দিয়েছেন। তিন থেকে চার ফুটের জায়গার ভাড়া মাসিক ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। অগ্রিম দিয়ে হয় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।

দুদিন নিউমার্কেট এলাকা ঘুরে জানা গেল, ফুটপাতে দোকান বসাতে দৈনিক চাঁদার পাশাপাশি গুনতে হয় মাসিক চাঁদা। আর এই চাঁদার ভাগ পায় পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসন। টাকা তোলার দায়িত্বে থাকে লাইনম্যান।

মার্কেটের পশ্চিম পাশের লাইনম্যানের দায়িত্বে আছেন ছাত্তার মোল্লা। তিনি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। পূর্ব পাশে লাইনম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ইব্রাহিম ইবু। ইসমাইল, বিপ্লব, মোরশেদসহ একাধিক লাইনম্যানের নামও এসেছে সময় সংবাদের অনুসন্ধানে।

শুধু ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে নয়, চাঁদাবাজি হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশা থেকেও। এক নম্বর গেটে দুই নিরাপত্তারক্ষী মাসুদ ও ওহাবকে দেখা গেল প্রতিটি সিএনজি থেকে চাঁদা নিতে।

বাংলাদেশ হকার্স লীগের সভাপতি আবুল কাসেম বলছেন, যেখানেই হকার আছে, সেখানেই আছে লাইনম্যান। আছে চাঁদাবাজি।

তিনি বলেন, নিউমার্কেটে চাঁদাবাজদের সর্দার হলেন- ইব্রাহিম ওরুফে ইবু, সাত্তার মোল্লা, ইসমাইল, বিপ্লব, মোর্শেদসহ আরও অনেকে। ফুটপাতে ২০০ জন হকারকে একজন লাইনম্যান নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এই একজন লাইনম্যানকে নিয়ন্ত্রণ করে পুলিশ। চাঁদাবাজদের যে নামগুলো বললাম, দেখা গেল, কয়েকদিন পর পুলিশ তাদেরকে বাদ দিয়ে নতুন কয়েকজনকে নিয়োগ দেবে।

তিনি আরও বলেন, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, মতিঝিল, শাহবাগ, গুলশান, বনানী, সূত্রাপুরসহ সারাদেশের যেখানেই হকার আছে, সেখানেই লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজ আছে। আর যেখানে লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজ আছে, সেখানে পুলিশের সহযোগিতা আছে। দিনে লাখ লাখ টাকা তারা নিয়ে যাচ্ছে। এসব চাঁদা কেন দিচ্ছে? পুলিশের ভয়ে, ক্ষমতার ভয়ে, পদের ভয়ে। যাদের পদপদবি আছে, তারাই টাকাটা পাচ্ছেন।

২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে বছরে এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। প্রতিদিন আদায় হয় ৬০ কোটি টাকারও বেশি। তখন ঢাকায় হকার ছিল ৩ লাখ। এখন প্রায় সাড়ে তিন লাখ।

গবেষক দলের প্রধান ড. মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, সবার নাকের ডগা দিয়েই চাঁদাবাজি হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি, সবার মাঝেই চাঁদার টাকা কিছু না কিছু যাচ্ছে।

পুলিশ বলছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে চাঁদাবাজির বিষয়টি। অভিযোগ প্রমাণ হলে ছাড় পাবে না পুলিশও।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা পুলিশ যে এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে তথ্য পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের পর আবারও আলোচনায় উঠে আসে নিউমার্কেটকেন্দ্রিক ফুটপাতে চাঁদাবাজির বিষয়টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁদাবাজির এই বিশাল সিন্ডিকেটের কাছে বিভিন্ন সময় ছাত্রদের নিয়ে ছড়ানো চাঁদাবাজির অভিযোগ কিছুই নয়।

আরবিসি/২৪ এপ্রিল/মানিক


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category