আরবিসি ডেস্ক : নানান উদ্যোগের পরও ভরা মৌসুমে বাজারে আলুর অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ায় আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। এরপর বাজারে দাম খানিকটা কমলেও ক্ষেতে অনেকটাই কমে এসেছে।
তবে এবার তাতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন দিনাজপুরের কৃষকরা। তারা বলছেন, এবছর তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় আলুর ফলন এমনিতেই কম হয়েছে। তারওপর শীতের প্রকোপ থেকে আলু রক্ষা করতে খরচও হয়েছে বাড়তি।
তাই এবার আলু চাষ করে লাভ তো দূরে থাক, উৎপাদন খরচ উঠা নিয়েই শঙ্কা তাদের। তবে এমন দাবি মানতে নারাজ স্থানীয় কৃষি বিভাগ। তারা বলছেন, বরং এখন আবহাওয়া ভালো থাকায় ও বাজারে ভালো দাম থাকায় কৃষকরা লাভবান হবেন।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায় দ্রব্যমূল্য কমাতে সবাইকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসময় তিনি বিশেষ করে পরিবহনের ক্ষেত্রে বা পাইকারি বাজারে, অথবা মজুতদারি, এসব জায়গায় চাঁদাবাজি ও অবৈধ মজুতদারি বন্ধ করার কথা বলেন।
সেই সঙ্গে কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পায়, সেটার দিকে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা দেন তিনি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এবার প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশনাকে বাস্তবায়নের জোর দিয়ে ক্ষেতের কৃষকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আলুর ভালো চাহিদা ও বাজারে ভালো দাম থাকায় লাভের আশায় দিনাজপুরের হিলিতে আলু চাষে ঝুকেছিলেন কৃষকরা।
কিন্তু ঠিক যখন ক্ষেত থেকে আলু উত্তোলন শুরু হবে, এমন সময়ে আমদানির ফলে দাম কমে গেছে। তাই এবারে আলু চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা।
হিলির চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক পলাশ বসাক বলেন, এবার বাজারে যে আলুর দাম উঠেছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি। সেই হিসাব করে আমরা আশা করেছিলাম আলু আবাদ করে ভালো দাম পেলে লাভবান হতে পারবো। যে কারণে আগের বছরের তুলনায় এবার বীজ, সারসহ অন্যান্য খরচ কিছুটা বেশি হলেও আলু আবাদ করেছিলাম।
শুরুর দিকে আবহাওয়া ভালো থাকায় আলুর গাছও ভালো হয়েছিল। কিন্তু মাঝে এমন শীত আর কুয়াশা পড়লো এতে করে গাছে পচন ধরে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকবার করে ওষুধ স্প্রে করে সেই আলুর গাছ রক্ষা করা হয়েছে।
কিন্তু তারপরেও আলুর ফলন ব্যাহত হয়েছে। গতবার এক বিঘা জমিতে ১০০ মন আলুর ফলন হলেও এবারে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ৫০ থেকে ৬০ মনের বেশি হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘এরপরও বাজারে আলুর ভালো দাম থাকায় আমরা লাভের আশা করছিলাম। কিন্তু ঠিক যে সময় আমাদের জমি থেকে আলু উঠতে শুরু করবে, এমন সরকার আলু আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এতে করে আলুর বাজার ২ হাজার টাকা মন থেকে কমে নেমে এসেছে ৬০০ টাকায়।
এবারে এক বিঘা জমিতে আলু আবাদ করতে ৩৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে যে আলুর দাম তাতে করে লাভ তো দূরে থাক, আমাদের যে বিঘা প্রতি আলুর উৎপাদন খরচ সেটিই উঠবে কিনা জানি না। এর ফলে এবারে আলু আবাদ করে লোকসান গুনতে হবে আমাদের।’
ইসমাইলপুরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এবারে লাভের আশায় আলু আবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেই আশায় তো আমাদের গুড়ে বালির মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারত থেকে আলু আমদানির ফলে আলুর দাম কমে এসেছে বর্তমানে ৬০০ টাকা করে মন আলু।
কোথায় ২ হাজার টাকা আলুর মন ছিল কিন্তু এখন এই দামে তো আলু বিক্রি করে আমাদের পড়তা হচ্ছে না। যে হারে খরচ বেড়েছে, বিশেষ করে সার, বীজ, হালচাষ এককথায় সবকিছুর দাম বেশি কিন্তু শুধু আলুর দাম কম। যার কারণে আমাদের এবার আর আলু চাষাবাদ করে লাভ করা যাচ্ছে না।
একই এলাকার আরেক কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবারে আলুর ভালো দাম ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে লাভের আশায় আলু আবাদ করেছিলাম। শীত ও কুয়াশার কারণে কয়েকবার করে পচারি দেখা দিলো আলুর গাছে।
বেশ কয়েকবার করে বাড়তি খরচ করে ওষুধ ছিটিয়ে সেই পচারি থেকে আলুর গাছ রক্ষা করলাম। কিন্তু এখন আলুর দাম নেই, এই দামে তো আমাদের খরচ উঠছে না।
আলু তোলার কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ইয়াসিন আলী বলেন, ‘এই মাঠে পলাশ ভাই (কৃষক) আলু আবাদ করেছিলেন। সেই আলু এখন ক্ষেত থেকে তোলার কাজ করছি আমরা শ্রমিকরা।
কিন্তু এবারে বৈরী আবহাওয়ার কারণে অতিরিক্ত শীত ও কুয়াশার কারণে আলুর ফলন গতবারের চেয়ে অনেকটা কম হয়েছে। এর উপর আলুর দাম না থাকায় মহাজন আমাদের যে মজুরি দেবেন, সেটা নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে।’
হাকিমপুর উপজেলা কৃষি অফিসার আরজেনা বেগম বলেন, চলতি মৌসুমে হাকিমপুর উপজেলায় ১ হাজার ১১ হেক্টর জমিতে আলু চাষাবাদ করা হয়েছে। শুরুর দিকে আবহাওয়া ভালো থাকলেও মাঝে তীব্র শীতের কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে তবে পুরোপুরি এখনও শেষ হয়নি।
বর্তমানে আবহাওয়া ভালো থাকায় আমরা আশা করছি কৃষকরা আলুর ভালো ফলন পাবেন। সেই সঙ্গে আলুর বাজার মূল্য ভালো থাকায় কৃষকরা লাভবান হবে বলে আমাদের আশা।’ লাভজনক হওয়ায় আগামীতে আলুর আবাদ আরও বাড়বে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, এবারে আলুর গড় ফলন হেক্টরে ২৩ মেট্রিক টন করে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেব মোতাবেক চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২৬ হাজার ৩৬০ মেট্রিকটন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৫২৭ হেক্টর জমি থেকে ১১ হাজার ৯৭৩ টন আলু উত্তোলন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ১ ফেব্রুয়ারি ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। হিলি স্থলবন্দরের ৫০ জন আমদানিকারক ৩৫ হাজার টন আলু আমদানির অনুমতি পায়।
সেই মোতাবেক এলসি খুলে গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে হিলিসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আলু আমদানি শুরু হয়। এর আগে সরবরাহ কমের অজুহাতে দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠলে গত বছরের ৩০ অক্টোবর ভারত থেকে আলু আমদানির অনুমতি দেয় সরকার।
ব্যবসায়ীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানির সময়সীমা নির্ধারণ করে সরকার। পরবর্তীতে সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৫ ডিসেম্বর থেকে বন্দর দিয়ে আলু আমদানি বন্ধ ছিল।
আরবিসি / ১৬ ফেব্রুয়ারী / অর্চনা