আরবিসি ডেস্ক : ফেব্রুয়ারি মাসটি পুরো বিশ্বের মানুষের কাছেই বিশেষ। বিশেষ করে প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে যায় নানান দিবস। রোজ ডে, প্রোপজ ডে, চকলেট ডে, টেডি ডে, প্রমিজ ডে, হাগ ডে, কিস ডে এবং সবশেষে ভ্যালেন্টাইন’স ডে।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। পুরো বিশ্বে পালিত হচ্ছে এই দিনটি। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নয় সবাইকে ভালোবাসা বিনিময় করার দিন আজ। তবে ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইনস ডে যার নামে পালন করা হয় সে মানুষটিকে চেনেন কি?
এই দিবসের সূচনা প্রাচীনকালেই। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানি জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই।
আবার কেউ বলেন, রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের সময় শুরু এই দিবস। সে সময় বিশ্বজয়ী রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে। আর যুদ্ধের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী সেনাবাহিনী। কিন্তু, সমস্যা দাঁড়ায় তরুণীদের নিয়ে। তারা যে কিছুতেই তাদের পছন্দের পুরুষটিকে যুদ্ধে পাঠাতে চায় না।
তখন সম্রাট ক্লডিয়াস মনে করলেন, পুরুষরা বিয়ে না করলেই বোধ হয় যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। ভাবনাটার বাস্তবায়ন করলেন তিনি। বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন সম্রাট। তিনি ঘোষণা দেন, আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ। তার মতে, যুবকরা যদি বিয়ে করে তবে যুদ্ধ করবে কারা?
কিন্তু ভালোবাসার তাড়নায় ছুটে চলা তারুণ্যকে কি আর আইন করে বেধে রাখা যায়? সম্রাট ক্লডিয়াসের এ অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন এক যুবক। যার নাম সেন্ট বা সন্তো ভ্যালেন্টাইন। তিনি ছিলেন এক রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক।
তিনি নিজে সব প্রেমে আবদ্ধ তরুণ -তরুণীর এক করার ব্যবস্থা করলেন, বিয়ে দিলেন সবাইকে। কিন্তু সেই প্রথা বেশি দিন তার ধারা বজায় রাখতে পারলো না। ধরা পড়লেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে বন্দি করা হলো।
অসীম সাহসী ভ্যালেন্টাইনের প্রতিবাদে খেপে উঠলেন সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু, তখন নতুন করে আরেকটা সমস্যা দেখা দিল। তার অনেকে ভক্তরাই ভ্যালেন্টাইন’কে দেখতে কারাগারে যেতেন। দিয়ে আসতেন তাদের অনুরাগের চিহ্ন হিসেবে অনেক ধরনের ফুলের শুভেচ্ছা। তাদের মধ্যে একটি অন্ধ মেয়েও ছিল।
শোনা যায়, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তার অন্ধত্ব দূর করেন। শুধু যে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাই নয়, সঙ্গে মেয়েটির প্রেমে আবদ্ধ হয়ে ধর্মযাজকের আইন ভেঙে তাকে বিয়েও করে জীবনসঙ্গী করেন তিনি। কিন্তু তারপর? এমন একটা খবর রাজার কানে পৌঁছোতেই তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে, প্রিয়াকে লেখা ভ্যালেন্টাইনের শেষ চিঠিতে ছিল- ‘লাভ ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’৷ আর সেই দিনটিও ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ গেলাসিয়াস প্রথম এই দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
তবে এটি নিয়েও ভিন্ন মত রয়েছে অনেকের। কারও কারও মতে, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামে একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি রোগীদের প্রতি ছিলেন ভীষণ সদয়। অসুস্থ মানুষের ওষুধ খেতে কষ্ট হয় বলে তিনি তেঁতো ওষুধ ওয়াইন, দুধ বা মধুতে মিশিয়ে খেতে দিতেন। সেই ডাক্তার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টধর্ম তখন মোটেও জনপ্রিয় ছিল না। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের শাস্তি দেওয়া হতো।
একদিন রোমের এক কারা প্রধান তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন চিকিৎসার জন্য। ভ্যালেন্টাইন কথা দিয়েছিলেন তিনি তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করবেন। মেয়েটির চিকিৎসা চলছিল এমন সময় হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। ভ্যালেন্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তার আগে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাকে হত্যার পর কারা প্রধান চিরকুটটি দিয়েছিলেন মেয়েটিকে। তাতে লেখা ছিল, ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ । মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল কারণ এরই মধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দু’চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল।
ভালোবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকে এই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তির বিষয়ে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নমত রয়েছে। এই মতের লোকেরা বলেন,ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়জনকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন।
পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কেউ বলেন,মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজেবেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে।
৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যালেন্টাইন’স ডে- এর উদ্ভব হলেও এটি বিশ্বব্যাপী প্রথম দিকে তেমনিভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্ম দিনের উৎসব,ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না।
খ্রিস্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উৎযাপন করা নিষিদ্ধ করেছিল। এ ছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে এসে ভ্যালেন্টাইন’স দিবসের কদর প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরা এই দিবস উপলক্ষে এই দিনে প্রায় কয়েক কোটি ডলার ব্যয় করে। ভালবাসা দিবসের জন্য মানুষেরা কার্ড, ফুল, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই দিনে প্রায় আনুমানিক ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
১৭০০ শতাব্দীতে দিনটিকে জনপ্রিয়ভাবে পালন শুরু করে ব্রিটেন। শুরু হয় হাতে লেখা কার্ড অথবা উপহার বিনিময়। এরপর ১৮৪০ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম ‘ভালবাসা দিবস’-এর উপহার তৈরি শুরু করেন এস্থার এ হাওল্যান্ড। উল্লেখ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ‘ভ্যালেন্টাইন কার্ড’-টি সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
আরবিসি/১৪ ফেব্রুয়ারী/ক