স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে একই মঞ্চে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। বুধবার (২৬ জুলাই) দুপুরের মধ্যে কয়েক দফায় শেষ করা হয়েছে ফাঁসির চূড়ান্ত মহড়াও। সবকিছু ঠিক থাকলে যেকোনো সময় দেশের বহুল আলোচিত এ হত্যা মামলার দোষী দুই আসামিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হবে।
বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেমড সেলে বন্দি রয়েছে, আসামি ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম। তাদের দুই জনকে ফাঁসিতে ঝুলাতে এখন আটজন জল্লাদ প্রস্তুত। এছাড়া মরদেহ পরিবহনের জন্য দুইটি কফিন এবং আলাদা দুটি অ্যাম্বুলেন্সও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের আগে দুই আসামিকে তওবা পড়াবেন কারা মসজিদের ইমাম মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম। তবে এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানায়নি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) সকালে ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের পরিবার এবং দুপুরে জাহাঙ্গীর আলমের পরিবার দেখা করে গেছেন। ফাঁসি কার্যকরের আগে জেলকোড অনুযায়ী এটিই পরিবারের সঙ্গে ফাঁসির আসামিদের শেষ দেখা।
ফাঁসি কার্যকর নিয়ে গোপনীয়তা:
স্মরণকালের আলোচিত মামলায় দুই আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করছে কারা কর্তৃপক্ষ। ফাঁসির কার্যকরের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে তাই সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। দু’দিন থেকে তাই একেক সময় একেক ধরনের তথ্য পাচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (২৭ জুলাই) রাত ১০টা ১মিনিটে ফাঁসি কার্যকরের কথা রয়েছে। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে একটিই ফাঁসির মঞ্চ থাকায় সেখানে পর্যায়ক্রমে আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকরের কথা রয়েছে।
ফাঁসির রায় কার্যকরে প্রস্তুত আট জল্লাদ:
রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যামামলার ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য আটজন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সাধারণত একজন আসামির ফাঁসি কার্যকর করতে চারজন জল্লাদ প্রয়োজন হয়। তাই দুইজন আসামির জন্য আটজন জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে একজনকে দেওয়া হয়েছে প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব। বাকিরা সহযোগী জল্লাদ হিসেবে দুই আসামির ফাঁসি কার্যকরে নিয়োজিত থাকবেন। এর মধ্যে উজ্জ্বল, ইসলাম, আলম ও ওয়াহাব ওই চার জনের নাম জানা গেছে। আর তারা সবাই বিভিন্ন মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আসামি।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য:
রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের ফাঁসি কার্যকর প্রস্তুতি ও দিনক্ষণ প্রশ্নে রাজশাহীর কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) মো.কামাল হোসেন বলেন, ‘তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। দিনক্ষণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। ফাঁসি কার্যকর হলে সবাই তা জানতে পারবেন।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আবদুল জলিল বলেন, ড. তাহের হত্যা মামলার দুই আসামির ফাঁসি জেলকোড মেনেই কার্যকর করা হবে। তারা সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছেন। জেলকোড অনুসরণ করে সকল কার্যক্রম চলছে। এর বাইরে আর কিছু এই মুহূর্তে বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মো. নিজাম উদ্দিনও পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, একটু অপেক্ষা করুন। সময় হলে সবকিছুই জানতে পারবেন।
প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি:
রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পৌঁছেছিল ৫ জুলাই। কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এর প্রায় ছয় মাস আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছিলেন। জুনের শেষ সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। জেলকোড অনুযায়ী, চিঠি হাতে পাওয়ার ২১ দিন থেকে ২৮ দিনের দিনের মধ্যে যেকোনো দিন ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেই হিসাবে আজ ২৬ জুলাই চিঠি হাতে পাওয়ার ২১ দিন পূর্ণ হয়ে গেল। তাই বলা যায়, আজ থেকে যেকোনো সময় ফাঁসি কার্যকরে আর বাধা নেই।
সর্বশেষ রিটও খারিজ: রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি জাহাঙ্গীরের আটকের বৈধতার বিরুদ্ধে করা সর্বশেষ রিটও খারিজ করেন আপিল বিভাগ।
মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) সকালে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত এই আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সমরেন্দ্র নাথ গোস্বামী। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরশেদ। সর্বশেষ এই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ড. তাহেরের হত্যা ৭১’র বর্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। বাড়িতে তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম তার দেখাশোনা করতেন। পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি বাড়ির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় ড. এস তাহেরের মরদেহ। এরপর রাবি অধ্যাপক তাহেরের করা একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) সূত্র ধরে একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও রাবি ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, তার বাড়ির কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতারদের মধ্যে তিনজন আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক ড. এস তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সহযোগী অধ্যাপক মিয়া মো. মহিউদ্দিন এই হত্যার পরিকল্পনা করেন। বালিশ চাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের মরদেহ বাড়ির পেছনে নেওয়া হয়। মরদেহ গুমের জন্য জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে ড. তাহেরের মরদেহ ফেলা হয়।
২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় অধ্যাপক ড. এস তাহেরের মরদেহ। এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহী মহানগরের মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয় পুলিশ।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুইজনকে খালাস দেন। দণ্ডিতরা হলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ড. এস তাহেরের বাড়ির সেই কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের স্ত্রীর ভাই আব্দুস সালাম।
খালাসপ্রাপ্ত চার্জশিটভুক্ত দুই আসামি হলেন- রাবি ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী। ২০০৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন। শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল রাবি অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির (নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের সম্বন্ধী আব্দুস সালাম) দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন হাইকোর্ট।
এরপর আবারও রিভিউ আবেদন করেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান দুই আসামি। এই বছরের গত ২ মার্চ এ হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।
নিম্ন আদালতে দুজনের মৃত্যুদণ্ডের যে রায় এসেছিল তাই বহাল থাকে আপিল বিভাগেও। আর খারিজ হয়ে যায় রিভিউ আবেদনও। এজন্য প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না তাদের কাছে। এরপরও অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় দণ্ডিত এ দু’জনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনরা। কিন্তু উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরবর্তীতে সেই আবেদনও খারিজ করে দেন বিচারপতি মো. জাফর আহমেদ ও মো. বশির উল্ল্যার হাইকোর্ট বেঞ্চ। মূলত এরপরই কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির দুই আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে এ ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নিজেদের প্রাণভিক্ষার আবেদন জানান। তবে রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন।
আরবিসি/২৭ জুলাই/ রোজি