স্টাফ রিপোর্টার : সাত বছর আগে সৌদিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজশাহীর বাগমারার উপজেলার রুবেল হোসাইন। স্বপ্ন পুরনের আশায় সৌদিতে গিয়ে কাজে যোগ দেন একটি সোফা কারখানায়। সেখানে ভালই চলছিলো তার। সেখান থেকে নিজ গ্রামে নয় মাস ছয় দিন আগে মোবাইলে ভিডিও কনফরেন্সে বিয়ে করেন আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্কে থাকা মরিয়ম আক্তারকে। বিয়ের পর তাদের সরাসারি দেখা হয় নি। প্রায়দিনই ফোনেই সীমাবদ্ধ ছিলো কাদের কথা। স্বামীর সঙ্গে কথা হলেও দেখা হওয়ায় আগেই বিধবা হয়ে গেলেন মরিয়ম। তাদের লালিত সংসার আর করা হলো না।
সৌদি প্রবাসী স্বামীর মৃত্যুর খবরে যেন আকাশ ভেঙে পড়ে কলেজছাত্রী মরিয়ম আক্তারের। আহাজারি করা মরিয়মকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পাচ্ছেন না স্বজনরা। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারইপাড়া গ্রামে স্বামী রুবেলের বাড়িতে মোবাইল ফোনে স্বামীর ছবি দেখে প্রলাপ করছিলেন মরিয়ম আক্তার। তাকে থামানো যাচ্ছে না। তার কান্না আর আহাজারিতে পুরো পড়ার পরিবেশই এখন স্তব্ধ। তার কন্ঠে এখন স্বামীকে একবার হলেও দেখার আকুতি।
শুধু মরিয়ম নয়, রাজশাহীর বাগমারায় সৌদি প্রবাসী চারজনের বাড়িতে এমন আহাজারি চলছে শনিবার সকাল থেকেই। শুক্রবার সৌদি আরবের একটি সোফা কারখানায় অগ্নিকান্ডে নিহত হন বাগমারা উপজেলার চারজন। এরপর থেকেই তাদের পরিবারে নেমেছে এসেছে কান্না আর বুকফাটা আর্দনার্দ। রবিবারের একই অবস্থা দেখা যায়। এদের মধ্যে মরিয়মের কান্না থামাতে পারছে না কেউ। তার কান্না আর আর্তনাদে কাদছেন প্রতিবেশীরাও। সান্তনা দিতে এসে অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। এমন দৃশ্য দেখা যায় রাজশাহীর বাগমারায় নিহত চারজনের পরিবারে। তারা এখন প্রিয়জনদের লাশের অপেক্ষা করছেন।
মরিয়ম জানান, গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে স্বামী রুবেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। দেশে আসার জন্য শুক্রবার কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার রাতে আবার কথা বলবে বলেছিল। রাতে মোবাইলে কল দিয়েছিলেন মরিয়ম। কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। শনিবার সকাল ৮টার দিকে রুবেলের প্রবাসী বড় ভাই ফোনে জানান ফার্নিচারের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে রুবেল মারা গেছে। শুধু রুবেল নয় একই কারখানায় অগিকান্ডে আরো ৯ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে রুবেলসহ অপর তিনজনই বাগমারার বাসিন্দা।
এদের মধ্যে রুবেল ২০১৬ সালে সৌদি আরব পাড়ি জমান। তার বড় দুই ভাই আগে থেকেই প্রবাসী। বড় ভাই সৌদি আরব এবং মেজো ভাই দুবাই থাকেন।
মরিয়মের বাবা কৃষক মঞ্জুর রহমানের সঙ্গেও জামাতা রুবেলের নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হতো। তিনি বলেন, ছেলেটা ভালো, এমন জানার পর না দেখেই মোবাইলের মাধ্যমে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়ের ভালোর জন্য প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। এখন ঘরসংসার না করেই মেয়ে স্বামীকে হারাল। রুবেলের বাবা জফির উদ্দিন বলেন, ছেলে দেশে এলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারার কথা ছিল। আধা পাকা বাড়িটির পুরোটাই পাকা করার পরিকল্পনা ছিল। তবে তা আর হলো না। বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বৃদ্ধ।
সৌদিতে নিহত অপর তিনজন হলেন, উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের জমিরের ছেলে মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, শাহাদাত হোসাইনের ছেলে মো. আরিফ এবং বড় মাধাইমুরি গ্রামের আনিসুর রহমান সরদারের ছেলে ফিরোজ আলী সরদার।
ফিরোজের বাবা আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমার তো এখন আর চাওয়ার কিছু নাই। শুধু লাশটাই চাই। এখন লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আনিসুর রহমানের দুই ছেলে। এর মধ্যে ফিরোজ থাকতেন সৌদিতে। তার ছোট ভাই ফারুক সিঙ্গাপুরে থাকে। এখন এলাকাবাসী হিসেবে আমাদের একটাই দাবি, লাশটা যেন দ্রুত আসে।’
আগুনে নিহত সাজেদুল ইসলাম আরিফের বাগমারার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। রবিবার সকালে আরিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে বাবা শাহাদাত হোসাইন বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছেন। সারারাত নির্ঘূম কেটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ছেলের লাশ দেখতে চান তারা।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল করিম সরকার জানান, ‘লাশগুলো যেন দ্রুত আসে, আর পরিবারগুলো যেন ক্ষতিপূরণ পায়। এ ব্যাপারে আমরা সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করি। আমাদের এখন এটাই চাওয়া।’
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘বাগমারার এসি ল্যান্ডকে আমি নিহত শ্রমিকদের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। যত দ্রুত সম্ভব মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে তারা তৎপর আছে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে।’
প্রসঙ্গত, শুক্রবার সন্ধ্যায় সৌদি আরবের দাম্মামে ফার্নিচারের কারখানায় আগুনে ৯ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে চারজনই রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা।
আরবিসি/১৭ জুলাই/ রোজি