আরবিসি ডেস্ক: মহামারীর দাপট কমে আসায় এবার আর প্রথা ভাঙছে না; তিন বছর বাদে ভাষার মাসের প্রথমদিন থেকেই অমর একুশে বইমেলা আয়োজনের প্রস্তুতি সারছে বাংলা একাডেমি। এবারও বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি অংশজুড়ে বসবে বইমেলা। সবশেষ দুই বছর কোভিড মহামারীর কারণে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমদিন থেকে বইমেলা শুরু করা যায়নি।
এরও আগের বছর ২০২০ সালে মেলা শুরু হয়েছিল একদিন পিছিয়ে। প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি পর্দা উঠলেও ওইবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ভোট থাকায় তা একদিন পিছিয়েছিল। ভাইরাস সংক্রমণের বিধিনিষেধের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতাকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২১ সালে শুরু হয় মার্চে; আর পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্দা ওঠে বইমেলার।
এখন পর্যন্ত পরিকল্পনা করা সূচি অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারির বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত হয়ে মেলা উদ্বোধন করবেন। এর দুই ঘণ্টা পর বিকাল ৫টায় মেলার দুয়ার খুলবে সবার জন্য; যা চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এবার মেলার প্রতিপ্রাদ্য ঠিক হয়েছে ‘পড় বই গড় দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।
মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে ৩১ সদস্যের কমিটি কাজ করছে। এবার স্টল বিন্যাসে কিছুটা পরিবর্তন আসছে জানিয়ে নূরুল হুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারও মেলায় মূল মঞ্চ থাকবে বাংলা একাডেমি অংশে। আর গ্রন্থ উন্মোচন ও লেখক বলছি মঞ্চ থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে। নতুন ১২টি প্রকাশনীসহ মেলা পরিচালনা কমিটি ইতোমধ্যে স্টল বরাদ্দ দিয়েছে। শিগগির লটারির মাধ্যমে এগুলোর স্থান বিন্যাস করা হবে।
এবার ৬০৯টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৮৫৮টি ইউনিট বরাদ্দ দিয়েছে বাংলা একাডেমি। এছাড়া প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৪টি। বেশি স্টল ও প্যাভেলিয়ন থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। যেখানে ৪৭২টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১১টি ইউনিট; যার মধ্যে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ৪০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৬০৩ ইউনিট এবং শিশু চত্বরে ৭১টি প্রতিষ্ঠানকে ১০৮ ইউনিট দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৩টি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ১৪৭টি ইউনিট।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ শনিবার বইমেলার কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করেন। ভালো প্রস্তুতির কথা তুলে ধরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী মেলা পরিচালনা করা হবে। তা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে এবং নিয়ম ভাঙলে সাত সদস্যের টাস্কফোর্স কাজ করবেও জানান তিনি। টাস্কফোর্স গঠন বইমেলায় মুক্তচিন্তার প্রকাশে ‘বাধা’ তৈরি করবে কি না এমন প্রশ্নে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “একদমই না। বইমেলা মুক্তচিন্তার জায়গা। এখানে সবাই বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে বই লিখবেন, সেই বই প্রকাশ হবে। কিন্তু কাউকে কটাক্ষ করা, হিংসা বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো কাজ হলে মেলা পরিচালনা কমিটি নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।”
ভিন্নমতের বই প্রকাশের অভিযোগে এবার স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি আদর্শ প্রকাশনীকে। এ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী মাহাবুব রহমান সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে বলেছেন, তাদের স্টল বরাদ্দ না দেওয়ার মাধ্যমে বাংলা একাডেমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আদর্শকে স্টল বরাদ্দের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী খালিদ বলেন, “বইমেলার নীতিমালা মেনে তারা যদি আসেন, তাদেরকে স্টল দেওয়ার ব্যাপারে পরিচালনা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
বাংলাদেশের, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কোনো রকম কটাক্ষ করা হলে, সেখানে আপোষ করা হবে না বলেও জানান তিনি। মেলায় বরাদ্দের প্রাথমিক তালিকায় আদর্শ’র নাম না আসার কারণ নিয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “গত বছর তাদের বইয়ে কিছু বিষয় নিয়ে আপত্তি উঠেছিল, তাদেরকে সেটা জানানো হয়েছিল। মেলায় অংশ নেওয়া সকল প্রতিষ্ঠানকেই তো নীতিমালা মেনে চলতে হবে। একটা প্রকাশনীর জন্য তো আর নীতিমালা আলাদা হতে পারে না।”
২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণগত মানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থের মধ্য থেকে দেওয়া হবে ‘চিত্তরঞ্ছন সাহা স্মৃতি পুরস্কার’। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য দেওয়া হবে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’। ২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণগতমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে।
এছাড়া ২০২৩ সালে অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে স্টলের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচিত প্রতিষ্ঠানকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হবে। ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন মুক্তধারা প্রকাশনীর মালিক চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭৭ সালে তার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেন।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। পরের বছর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। ১৯৮৩ সালে মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের এই বইমেলা এখন বাঙালির মননের মেলায় পরিণত হয়েছে।
আরবিসি/২২ জানুয়ারি/ রোজি