স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহীতে একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে শীতের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তীব্র শীতে চরম অসহনীয় হয়ে উঠেছে রাজশাহীর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। টানা দুদিন ধরে সূর্যের দেখা মিলছে না রাজশাহী অঞ্চলে। সর্বশেষ বুধবার বেলা পৌনে তিনটার দিকে সূর্যের আলো দেখা দিলেও মুহুর্তে ঘন কুয়াশায় ম্লান হয়ে যায়।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানায়, দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পাশাপাশি কমছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও। সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান কমায় বেড়েছে শীতের তীব্রতা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অবর্ণনীয় দুর্ভাগে পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ। পথে-প্রান্তরে তারা সীমাহীন কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। এরই মধ্যে রাজশাহীজুড়ে শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছেন অনেকেই। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। অসহনীয় ঠান্ডার হাত থেকে শীতার্ত এই মানুষগুলোকে রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি পযার্য়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল।
এদিকে, মঙ্গলবারের পর বুধবারও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে পদ্মা পাড়ের রাজশাহী। তিনভর ঘন কুয়াশার চাদরে মুড়ি দিয়ে আছে পুরো রাজশাহী অঞ্চল। ফলে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান কমে এসেছে। আর এই কারণেই বেড়েছে শীতের দাপট।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র পর্যবেক্ষক লতিফা হেলেন জানান, বুধবার ভোর ৬টায় রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একদিন আগে মঙ্গলবার রাজশাহীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিলো ১৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের গত ২৯ ডিসেম্বর রাজশাহীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের এখন পর্যন্ত সর্বনিম্ন রেকর্ডকৃত তাপমাত্রা।
আবহাওয়া অফিস জানায়, চলমান ঘন কুয়াশা কেটে গেলে আরও তীব্র হবে শীত। বাড়বে জনদুর্ভোগ। মূলত ঘন কুয়াশা এবং ঠান্ডা বাতাসের কারণেই রাজশাহীতে তীব্র শীতে অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীর ওপর দিয়ে কোনো শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে না। আর কোনো কোনো সময় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রার ব্যবধান কমে যাচ্ছে। তখন শীত আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।
এদিকে শিরশির করে বইছে উত্তরী হাওয়া, কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সূর্য, পৌষের শেষার্ধে থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাওয়ায় কাঁপছে রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ঘন কুয়াশার কারণে বুধবার বিকাল পর্যন্ত রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় সূর্যের দেখা মেলেনি। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে আসায় মাঝারি থেকে তীব্র শীত অব্যাহত থাকার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
বুধবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের সর্বনিম্ন ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। রাজধানীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে সর্বত্র সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই মৌলভীবাজারে জেঁকে বসেছে শীত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে ঘন কুয়াশার কারণে দুপুর পর্যন্ত দেখা মিলছে না সূর্যের। কনকনে ঠাণ্ডায় ক্ষেত-খামারের কাজ আর গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কর্মজীবী মানুষেরা।
শ্রীমঙ্গল সবুজবাগ এলাকার অর্জুন মালাকার বলেন, প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যেও মাঠে কাজ করতে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ঘন কুয়াশার কারণে ক্ষেতের সবজি বাড়ছে না। প্রতি বছরের মত এবারও নির্ধারিত সময়ে মূলা চাষ করেছেন অর্জুন। তবে এখনো তার মূলা বড় না হওয়ার পেছনে কুয়াশাকে কারণ মনে করছেন তিনি। অন্যান্য সবজিতেও একই অবস্থা বলে জানান এই কৃষক।
এদিকে রাত ৮টার পর থেকে ঘন কুয়াশার কারণে শ্রীমঙ্গলে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। শ্যামলী পরিবহনের বাসচালক মো. স্বপন মিয়া জানান, কুয়াশার কারণে গাড়ি ধীর গতিতে চালাতে হচ্ছে। দিনের বেলাতেও সড়কে লাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে। ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীত আরও কয়েকদিন চলতে পারে বলে আভাসি দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া পর্যবেক্ষক মুজিবুর রহমান।
দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের নয় উপজেলায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। হিমালয় থেকে আসা হিম হাওয়ায় কাবু নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন শ্রমজীবী, শিশু ও বয়স্করা। দিনের অনেক সময় ঘন কুয়াশার কারণে রোদের দেখা না মেলায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চলে তাদের।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শাহীনুর রহমান সরদার জানান, হাসপাতালের ইনডোরে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। নতুন রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু আর বয়স্ক এবং বেশিরভাগই শীত ও ঠাণ্ডাজনিত রোগে ভুগছেন। দেশের উত্তরে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বুধবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস; আর কুড়িগ্রামের রাজারহাটে সর্বনিম্ন তাপামাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে ঘন কুয়াশার কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে যোগাযোগের নৌপথ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। বিআইডব্লিউটিসির পাটুরিয়া ঘাট শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম বলেন, ঘন কুয়াশার কারণে রাত ৩টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সকাল ৯টা ২০ মিনিট থেকে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হয়। যাত্রী ও গাড়ির চাপ থাকায় ১৫টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।
ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার কারণে রাতেই ঘাটে আটকা পড়ে ছোট বড় প্রায় শতাধিক যানবাহন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন চালক ও যাত্রীরা। দৌলতদিয়া ঘাটে যশোরের বেনাপোল থেকে ট্রাক নিয়ে আসা চালক আবজাল হোসেন বলেন, “রাত পৌনে ৩টার দিকে যখন ফেরিতে উঠি তখন দেখি খুবই কুয়াশা। চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পর জানতে পারি ফেরি চলাচল বন্ধ।”
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, রাত ৩টায় কুয়াশার কারণে নদী পথ দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। সে সময় নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে এই রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। “ফেরি বন্ধ থাকায় কিছু যানবাহন আটকা পড়ে। কুয়াশা কেটে যাওয়ায় সকাল সাড়ে ৯টায় পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হয়।”
বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী তিন দিনে আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান জানান, সারাদেশে রাত ও দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কমে যাওয়ায় দেশের উত্তর, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি হচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
বড় এলাকাজুড়ে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে মাঝারি এবং তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। টানা কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা কামার প্রবণতার মধ্যে পৌষের মাঝামাঝিতে দেশের সর্বত্র শীত ও কুয়াশার দাপট বেড়েছে।
জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়, চলতি মাসে ২-৩টি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এর মধ্যে একটি মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। আবহাওয়াবিদরা জানান, দিনের তাপমাত্রা তুলনামুলক কম থাকার পাশাপাশি উত্তরী হাওয়ায় রাজধানীসহ অনেক এলাকায় কনকনে শীতের অনুভূতি হচ্ছে। আরও কয়েকদিন এমন আবহাওয়া থাকবে।
আরবিসি/০৪ জানুয়ারি/ রোজি