নওগাঁ প্রতিনিধি : উত্তরের জেলা নওগাঁয় রয়েছে ৬টি নদী। নদীগুলো হচ্ছে- আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলশীগঙ্গা, শীব, পুণর্ভবা ও নাগর নদ। জেলার মধ্যে অন্যতম নদী হচ্ছে ছোট যমুনা ও তুলশীগঙ্গা। এক সময় বছরের সব সময় এসব নদীতে পানিতে ভরপর থাকতো।
এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহন করার মাধ্যম বলতে এই নদীগুলোয় ছিল একমাত্র পথ। শত শত পাল তোলা নৌকা জেলার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল বহন করে নিয়ে গেছে এসব নদী দিয়ে। জেলেরা সারা বছর এসব নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো।
জেলার প্রধান প্রাণকেন্দ্র ছোট যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত নওগাঁ শহর। এই নদীর তীরেই অবস্থিত কোর্ট, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সকল সরকারি দপ্তর। শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছোট যমুনা ও তুলশীগঙ্গা এক সময়ের খরস্রোতা নদী বর্তমানে দখল আর দূষণের শিকার হয়ে মরতে বসেছে। নদীর দুই পাশে দখল করে নির্মান করা হচ্ছে বড় বড় ভবন ও শিল্প কারখানা।
দীর্ঘদিন যাবত নদীটি খনন না করার কারনে পলি জমে কমে গেছে নদীর নাব্যতা। নদীটি এখন শহরবাসীর ময়লা আবর্জনা ফেলার ডাষ্টবিনে পরিনত হয়েছে। ব্যবসা বানিজ্যের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করতো এই ছোট যমুনা নদী। বড় বড় নৌকা ভিড়ত নদীতে। বর্ষা মৌসুমে পানি থাকলেও খরা মৌসুমে প্রতি বছর নদীটি মোটামুটি শুকিয়ে যায়। বর্তমানে নদীর উভয় পাশে ফ্লাডওয়াল নির্মিত হওয়ায় শহরের নদীর উভয় পাশের বাসিন্দারা তাদের পরিত্যক্ত সব ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলছে।
পুরো নদীটি এখন যেন একটি বিশাল ডাষ্টবিন। যার যখন মনে হয় তখন তাদের ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলছে। এদিকে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা দিনাজপুরের শালখুড়িয়া ইউনিয়নের বিলাঞ্চল এলাকা থেকে তুলশীগঙ্গা নদীটির উৎপত্তি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া নদী পরিচিতি নদটির দৈর্ঘ ১০০ কিলোমিটারর বা ৬২ মাইল। নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডিপুর এলাকায় ছোট যমুনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদটির প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে নওগাঁ সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
১৯৮৭ সালে সদর উপজেলার ছিটকিতলা এলাকায় স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয় এবং ওই এলাকায় তুলশীগঙ্গা থেকে একটি খাল খনন করে তুলশীগঙ্গার প্রবাহ ছোট যমুনার সঙ্গে মিলিত করা হয়। মূলত সেই সময় থেকেই তুলশীগঙ্গা তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলে। নদীর কোথাও কোথাও পানি শুকিয়ে শুষ্ক মাঠে পরিণত হয়। ওই সবস্থান দিয়ে পায়ে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। নদীর পাড় জুড়ে চলছে দখলদারিত্ব। নদের তীরবর্তী এলাকায় স্থাপিত চাতালের (চালকল) ছাই ফেলা, পৌরসভার পয়ঃবর্জ ও গৃহস্থালিসহ সব ধরণের বর্জে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে তুলশীগঙ্গা।
নওগাঁ পৌরসভার রজাকপুর এলাকায় তুলশীগঙ্গা সেতু দুই পাশে নদী জুড়ে যেন ময়লার ভাগাড়। সেতুর নিচে প্রচুর বর্জ্য ফেলা রয়েছে। নদীর বুক জুড়ে শুধুই কচুরিপানা। অনেক স্থানে নদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ে হেঁটে নদী পারাপার হচ্ছে মানুষ। সেতুর উত্তর দিকে তুলশীগঙ্গা নদীর উজানে পশ্চিম পাশে নদীর পাড়ে স্থাপিত তিনটি চালকলের উৎপাদিত ছাই ফেলা হচ্ছে নদীতে। ফলে ছাইয়ের স্তুপ জমে রয়েছে নদীর।
পূর্বে পাশে নদীর ভাটির অংশে পাড় ঘেঁষে স্থাপন করা হয়েছে দুটি চালকল, দুটি ইটভাটা, চাল-গমসহ বিভিন্ন খাদ্য শস্য ছাঁটাইয়ের একটি কারখানা রয়েছে। সেগুলো থেকেও নদী প্রতিনিয়ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। পৌরসভার ভবানীপুর, কাঠালতলি ও রজাকপুর এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও কারখানার নর্দমার ময়লা-দুর্গন্ধ পানি এসে পড়ছে নদী।
শহরের তুলশীগঙ্গা ও ছোট যমুনার নদী বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে স্থানীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন একুশে পরিষদ। সংগঠনটির সভাপতি ও নওগাঁ নদী রক্ষা কমিটির সদস্য এ্যাড ডিএম আব্দুর বারী বলেন, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, শিল্পকলকারখানার বর্জ ও নদী দখলের কারনে নদীগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক মানচিত্র থেকে। তেমনই একটি নদী আমাদের এই ছোট যমুনা।
সুন্দর বাংলাদেশের জন্য নওগাঁর ৬টি নদীকে পুনরায় জীবিত করা দরকার। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এসব নদীকে বাঁচাতে হবে। একুশে পরিষদ ছোট যমুনা ও তুলশীগঙ্গা নদীর দখল-দূষণ দূর করে নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। একাধিকবার মানববন্ধন করা হয়েছে। শুধু আন্দোলন করলে হবে না। প্রশাসন যদি সঠিকভাবে তদারকি করে তাহলেই নদীগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
নওগাঁ শহরের বাসিন্দা ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন জুয়েল বলেন, ময়লা আবর্জনা নদীতে ফেলা অত্যন্ত ক্ষতিকর জেনেও শহরের বাসিন্দারা ময়লাগুলো নদীতে ফেলছেন। এতে করে নদী দুষণ হচ্ছে। দূষন আর দখলের কবলে এক সময়ের যৌবন দীপ্ত নদীটি বর্তমানে দুটো নদী মরতে বসেছে। সবার উচিত আগামীর সুন্দর প্রজন্ম ও সুস্থ্য পৃথিবীর জন্য এই নদীটিকে বাঁচানোর জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া।
নওগাঁ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান বলেন, বর্তমান সরকার নদীবান্ধব সরকার। নদী রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী সব সময় কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমরাও কাজ করছি।
আরবিসি/০৮ অক্টোবর/ রোজি