স্টাফ রিপোর্টার : চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা-দূর্লভপুর ইউনিয়নে পদ্মা নদী আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। পদ্মার তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চরাঞ্চলের মানুষ। গত চারদিনে প্লাবিত হয়েছে একটি স্কুল, তিনটি জামে মসজিদ, আড়াইশোর বেশি বসতবাড়ি ও ২৩ হাজার বিঘা ফসলি জমি। আর হুমকির মুখে রয়েছে আমবাগান, সরকারি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ অবস্থায় ঘর-বাড়ি হারিয়ে দিশেহারা হয়েছেন হাজারো মানুষ।
জানা গেছে- ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কৃষক-জেলে ও পেশাজীবী মানুষেরা তার পেশা এবং পৈত্রিক ভিটেমাটি হারিয়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। পদ্মা নদীর অসময়ের এ ভাঙনের কবলে পড়ে আত্ম পরিচয়টুকুও হারিয়ে সঙ্গায়িত হচ্ছেন বাস্তচ্যুত মানুষ হিসেবে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভাঙন কবলিত বাসিন্দরা জানায়, পদ্মার পানি কমলেও ভাঙনের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এতে বিলীন হচ্ছে গাছপালাসহ ফসলি জমি, গ্রাম, সড়ক, ঘরবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত তিন দশকে নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও পাঁকা-দূর্লভপুর ইউনিয়নে ভাঙনের কবলে পড়ে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি, বসতভিটা, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ ও কবরস্থান।
জানা যায়, সদর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল নারায়ণপুর, চরবাগডাঙ্গা ও শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা-দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুরে পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে শিবগঞ্জের দুর্লভপুর ইউনিয়নের মনোহরপুর-রঘুনাথপুর থেকে শুরু করে নারায়ণপুর ইউনিয়নের জহুরপুর পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন শুরু হয়েছে। আর ভাঙনের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে নারায়ণপুর ইউনিয়নের চরের বাতিঘর খ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নারায়ণপুর আদর্শ মহাবিদ্যালয়সহ ১৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আশ্রয় কেন্দ্র, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, সদ্য নির্মিত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, সোলার প্লান্ট এবং স্থানীয় হাটবাজারসহ কয়েক শতাধিক একর ফসলি জমি।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত সদর উপজেলার নারায়ণপুর এলাকার বাদল রহমান জানান, ৩২ রশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন তারা। এখানে তাদের বাপ-দাদার জমিজমা ছিল। কিন্তু পদ্মার ভাঙনে সবকিছুই চলে গেছে।
শিবগঞ্জ উপজেলার নামোজগন্নাথপুরের পন্ডিতপাড়ার কৃষক টিটু জানান, পদ্মা নদীর কোল ঘেঁষেই তার বসতভিটা। গ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও গেলে যার মনে শান্তি মিলতো না। আজ সেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। পন্ডিতপাড়া থেকে পাশের গ্রামে চলে যাবো। পরের জায়গায় ঠাঁই নিচ্ছি। ধারদেনা করে ফের ঘর তুলতে হবে।
একই গ্রামের মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ১৯৪২ সালে আমার জন্ম। আগের বাড়ি ছিলো নদীর ওপারের গাঁ রঘুনাথপুরে। চারবার বাড়ি ভেঙেছি। এলাকায় মায়া বসলেও নিরাপত্তার তাগিদে ছাড়তে হয়েছে নিজের ভিটামাটি। বাপ দাদার থেকে পাওয়া জমিগুলোও নদীতে নেমে গেছে। নদী ভাঙনের তীব্রতা খুবই বেশি। কাঁদতে কাঁদতে তিনি আরও বলেন, পদ্মা নদীতে ভাঙনের কারণে গতবার কিছুই টানার সুযোগ পাইনি। কয়েকটা টিনের চাল, বাক্স আর গোলায় ভরা ধান আনতে পেরেছিলাম। তাছাড়া সব নদীতে ভেসে গেছিলো। অল্প সময়েই নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ময়েজ উদ্দিন বলেন, উপজেলার দুর্লভপুর ও পাঁকা ইউনিয়নের প্রায় ২৩ হাজার বিঘা জমি এখন পানির নিচে। আর দক্ষিণ পাঁকা এলাকার একটি উচ্চ বিদ্যালয় নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে। এতে ঘর-বাড়ি হারিয়ে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এদিকে প্রায় আড়াই’শ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর ওপারের বাসিন্দাদের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিল সরকার। এটিও এখন হুমকির মুখে। আর হুমকির মুখে রয়েছে প্রায় ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ভাঙন আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে শনিবার সকালে শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ও সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের পদ্মা নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক একেএম গালিভ খাঁন। এতে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইফফাত জাহান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) জুবায়ের হোসেন ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিঠুন মৈত্র প্রমূখ।
আরবিসি/২৭ আগস্ট/ রোজি