আরবিসি ডেস্ক : ঊনিশ বছর বয়সেই জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে কলকাতায় গিয়ে দেখা করেছিলেন ১৯৩৯ সালে।
এরপর ফিরে এসে গোপালগঞ্জে গঠন করেন মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ। দায়িত্ব নেন মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক পদে। ১৯৪১ সালে মেট্রিক পাস করে কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়াকালীন সময়েও ব্যস্ত থাকতেন রাজনীতি নিয়ে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্টের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সারা দেশ ঘুরে প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির জনক।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে একদল সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির বাসভবন আক্রমণ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়াও এ সময় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর দশ বছরের ছেলে শেখ রাসেল, দুই ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল এবং রোজি জামাল, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ নাসের, শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি। ওই সময় বিদেশে থাকার কারণে কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা প্রাণে রক্ষা পান।
১৯৪৬ সালের কলকাতায় সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের জেরে যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ধারণ করে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ দল গঠন করেন। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা নিয়েই তিনি গণতন্ত্রের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করে যারা ভেবেছিল ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে দেবে-তা পারেনি। বাঙালি আজও তাঁকে ভুলেনি। যতদিন থাকবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বহমান, ততদিন থাকবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বইয়ে বর্ণনা করেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শুক্রবার। ভোর ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙ্গে বেলজিয়ামে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে। জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী টেলিফোনে জরুরি কথা বলতে চান। কথা বলার জন্য শেখ হাসিনাকে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই-এক মিনিট পর শেখ হাসিনা ফিরে জানান, রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়ার সাথেই কথা বলতে চান। ফোনের রিসিভার ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী বলেন, আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুনি আপনারা আমার এখানে চলে আসুন’।
এরপর তাঁরা ব্রাসেলস ছেড়ে জার্মানীর বনের উদ্দেশ্য রওনা হন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে পৌঁছান। হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর উদ্যোগেই তাঁরা ভারতে যান। ভারত সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়াকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় নিয়ে যান। ইন্দিরা গান্ধীই সেদিন জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এ সংবাদ শুনে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ইন্দিরা গান্ধী তখন শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন- তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব, এখন তোমার কোনো অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলার মাটিতে ফেরেন শেখ হাসিনা। তিনি এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালতে ৭৫ এর ১৫ আগস্টের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঘোষিত বিচারের রায়ে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জন ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আটককৃত খুনি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি) ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মাধ্যমে কিছুটা হলেও জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।
পলাতক ৭ দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদকে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল দিবাগত রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়। তবে এখনও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বেশ কয়েকজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিদেশে পলাতক থাকার কারণে তাদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারকে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। এই রায় যেদিন পুরোপুরি কার্যকর হবে, সেদিন বাংলার মানুষ সপরিবারে জাতির পিতার হত্যার দায় থেকে মুক্তি পাবে।
আরবিসি/১৫ আগস্ট/ রোজি