আরবিসি ডেস্ক : ৩ হাজার টাকায় একটি নৌকা ভাড়া করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনোমতে সিলেট শহরে পৌঁছেছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জমির হোসেন। আশ্রয় নিয়েছেন নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে।
জমির হোসেন বলেন, উপজেলার উত্তর রণিখাই গ্রামের বাড়িতে ঘরে এখন ৭ ফ্টু পানি। এরমধ্যে ভবনের ওপরে আশ্রয়ে ছিলেন, সেখান থেকে নৌকা করে সালুটিকরে এসে পৌঁছান। তার মতো হাজার হাজার মানুষ এলাকা ছাড়ার অপেক্ষায়।
স্ত্রী সন্তান নিয়ে জমির হোসেন প্রাণে বাঁচলেও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার লাখো মানুষ রয়েছেন পানিবন্দি। বন্যায় গ্রাস করছে সব এলাকা। কোনো বাড়িই রক্ষা পাচ্ছে না বন্যার করাল গ্রাস থেকে।
অনাহারে থাকা লোকজন এখন কেবল প্রাণে বাঁচতে চান। কিন্তু একটি নৌকা মেলানো তাদের কাছে এখন সোনার হরিণ।
জমির হোসেন বলেন, এমন ভয়ানক দুর্যোগ ৫০ বছর বয়সে আর দেখিনি। উপজেলার প্রায় শতভাগ মানুষ পানিবন্দি। কেউ ত্রাণ চায় না, প্রাণে বাঁচতে চায়।
তাছাড়া গত ৪দিন ধরে বিদ্যুৎহীন থাকায় মোবাইলফোনে যোগাযোগ বন্ধ। ফলে উদ্ধারে সহায়তা চাওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্য মানুষকে খুঁজে খুঁজে উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কাছে মিনতি জানান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ভয়াবহ বন্যায় গ্রাস করছে একের পর এক এলাকা। মানুষ এখন ত্রাণ চায় না, প্রাণ বাঁচাতে চায়। কিন্তু হাওরে আফাল (ঢেউ) চলছে। ছোট নৌকা দিয়ে পারাপার বেশি ঝুঁকি, ডুবে যেতে পারে। ফলে অনেকে পানিবন্দি অবস্থায় আটকে আছেন। পানি বাড়তে থাকায় উদ্ধারের আর্তনাদে রয়েছেন মানুষজন। তাই মানুষজনকে উদ্ধারে বড় নৌকা নিয়ে যাওয়া দরকার।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মানুষ টাকা দিয়ে একটি নৌকা ব্যবস্থা করতে পারছেন না। ফলে উদ্ধারের আর্তনাদ সবখানে। কে কাকে উদ্ধার করবে, এমন দৃশ্য চোখে দেখে বরদাস্ত করার নয়।
জানা গেছে, একই অবস্থা সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সিলেট সদর উপজেলাতেও। এছাড়া সিলেটের ১৩টি উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে আশ্রয়ের সন্ধানে রযেছেন মানুষজন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী গোয়াইনঘাট এলাকার বাসিন্দা অধ্যাপক নুরুজ্জামান মনি বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যায়ও আমার বাড়ির উঠোনে পানি উঠেছিল। কিন্তু এবারের বন্যায় ঘরেও বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। তাঁর ৬৬ বছর বয়সে এ ধরনের প্লাবন কখনো দেখেননি।
তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি অনেকটা উঁচু স্থানে। তাই বাড়িতে কয়েক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন আমার বাড়ির লোকজনই আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র যেতে হচ্ছে।
অতিদ্রুত সিলেট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে, শুক্রবার (১৭ জুন) দুপুর থেকে সেনাবাহিনী নেমেছে উদ্ধার তৎপরতায়। বন্যার্তদের উদ্ধারে এবং সিলেট বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র সচল রাখতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে।
জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়, ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’- এর আওতায় ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এর ধারা ৩০ মোতাবেক বেসামরিক প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে সিলেট বিভাগের (সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা) বিভিন্ন উপজেলায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বন্যাকবলিত প্রান্তিক এলাকায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় মানবিক কার্যক্রম সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যে শুরু করেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেটে সব নদ নদীর পানি বেড়েই চলেছে। নদীগুলোর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহমান রয়েছে। বিকেল ৩টার হিসাব অনুযায়ী, সুরমার পানি কানাইঘাটে ১২৮ সেন্টিমিটার, সিলেটে সুরমার পানি ৭৭ সেন্টিমিটার, সারি নদীতে ৬৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কুশিয়ারার বিভিন্ন পয়েন্টেও নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে।
এদিকে, গত রাত থেকে সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে কেবল শহরের দিকে আসছেন। কিন্তু নগর এলাকারও প্রায় অর্ধেকাংশ বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এ অবস্থায়ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে নৌকা যোগে ও পায়ে হেঁটে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছেন।
আরবিসি/১৭ জুন/ রোজি