বিপ্লব দে পার্থ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পড়শি দেশ হিসেবে ভারত ও দেশটির সাধারণ মানুষের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের মাটি ও মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ভারতের গণমানুষের সহযোগিতার সেই ইতিহাস প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, একইসঙ্গে গৌরবেরও বটে। এমন একটা সময় লিখছি, যখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার করেছে বাংলাদেশ। ভারতও নিজেদের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পালন করছে, সঙ্গে রাজ্য হিসেবে মেঘালয়ও উদযাপন করছে ৫০ বছর।
দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ এই সময়ে পড়শি দেশ ভারত মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর সেই সময়ের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করে নিয়েছে সাদরে। বীরবন্ধুর দেশ মেঘালয়ে সেই সফরে আরেকবার স্মরণের আয়নায় উঠে এলো একাত্তরের সেই স্মৃতি। যেখান থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, যেখানকার মানুষের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল জনমত, যেখানে মিলেছিল খাবার ও থাকার স্থান। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে গত ৯ মে থেকে ১৪ মে পর্যন্ত ভারতের সেই মেঘালয় রাজ্য ভ্রমণ করেছে ২৫ জনের একটি ডেলিগেশন টিম। সেখানে ছিলেন ১৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তিন জন সাংবাদিক, দুই জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও দুই জন তরুণ নেতা।
৯ মে বাংলাদেশের সিলেটের তামাবিল হয়ে ভারতের ডাউকি বর্ডারে পৌঁছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেই দলটি। সেখানে তাদের লালগালিচা সংবর্ধনা দেয় ভারতের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফ। এসময় উষ্ণ অভ্যর্থনা ও মনভরানো আপ্যায়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘ ৫০ বছর পর ভারতের সেই স্মৃতিভরা মাটিতে পা রেখে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা তাদের বীরত্বগাথা স্মৃতিকথায় মেতে ওঠেন সবার সঙ্গে।
ডাউকি থেকে রাজকীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যাওয়া হয় মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে। শিলং যাওয়ার পথে চোখে পড়ে সবুজ প্রকৃতি। দিগন্তজুড়ে সবুজের ছোঁয়া। দৃষ্টিতে নয়নাভিরাম। দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়। আকাশে মেঘের অবিরাম লুকোচুরি। প্রতিনিয়ত আভা ছড়ায় সৌন্দর্য। আলোয় ভরা বিস্মৃত আঙিনা। সুন্দর পরিপাটি, শৃঙ্খলিত একটি রাজ্য। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সমষ্টি। যেখানে রয়েছে অরণ্য, জলপ্রপাতের ছড়াছড়ি। এই বৃষ্টিতো, এই রোদ। তবে সেই রোদের তীব্রতা নেই, আছে কোমলতা। আবহাওয়া এত মনোরম যে, প্রথম দেখায় প্রেমে পড়বেন যে কেউ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভৌগোলিক কারণে মেঘালয়ের বালাট ও ডাউকি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্থান। এ দুটি কেন্দ্র দিয়ে এপ্রিলের শুরু থেকেই সিলেট, ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনার মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেন। মেঘালয়ের আমপাতি গ্রাম হয়ে উঠেছিল সেসময় ছোট্ট একটি বাংলাদেশ। বালাটে গড়ে উঠেছিল ‘ইয়ুথ রিসেপশন ক্যাম্প’। মেঘালয়ের তুরা ও ডাউকিতে গড়ে উঠেছিল বড় দুটি প্রশিক্ষণ শিবির। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো। সেসময় মেঘালয় সরকার ও জনমানুষের সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসকদের গণহত্যা ও বর্বরতার প্রতিবাদে শিলংয়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী রাজধানীতে শোভাযাত্রা বের করেন। পুরো একাত্তর সালজুড়েই বাংলাদেশের সমর্থনে মিছিল-মিটিংয়ে মুখর ছিল মেঘালয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবিতে শিলং, ডাউকি, বালাটে পালন করা হয়েছে বনধ, অবরোধ ও অনশন।
ছয়দিনের এই সফরে মুক্তিযোদ্ধারা নিজ নিজ স্মৃতিচারণে ফিরে গিয়েছিলেন সেই একাত্তরে। কীভাবে মেঘালয়ে এসেছিলেন, কীভাবে ট্রেনিং করেছেন, কীভাবে জনমত গড়ে তুলেছিলেন, একাত্তরে মেঘালয়ের রাস্তাঘাট কেমন ছিল, মেঘালয়ের মানুষ কীভাবে সহযোগিতা করেছিল, তা ফুটে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে। ডেলিগেশনে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবার বয়স ছিল ৭০-এর বেশি। কিন্তু এই সফরে মনে হয়নি তাদের কারও এত বয়স হয়েছে। তাদের স্মৃতিচারণে মনে হচ্ছিল কিছু তরুণ ছুটে চলছেন, মেঘালয়ের এদিক-ওদিক।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেই সময়ের স্মৃতিগুলো তরুণদের মাঝে তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন যে, মনে হচ্ছিল আরেকবার যেন যুদ্ধে নেমে যাবেন তারা ডেলিগেশন টিমে তরুণ যারা গিয়েছিলেন, তারাও শুনেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা। নবীন-প্রবীণে মিলে একাকার হয়ে উঠেছিল মেঘালয়। ডেলিগেশন টিম যখন কোথাও যেত, তখন মনে হতো এক টুকরো বাংলাদেশ মেঘালয়ের মাঝ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। বিশেষ করে, মেঘালয় সরকারের আতিথেয়তা সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
সফরের দ্বিতীয় দিন ১০ মে ডেলিগেশন টিমকে মেঘালয় সরকারের আর্টস অ্যান্ড কালচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও যুগ্ম সচিব স্বাগত জানান এবং উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করেন। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার তুলে দেওয়া হয় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে। এরপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে প্রতিনিধিদল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডের কমান্ডার এয়ার মার্শাল ডি কে পাটনায়েকের পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান এয়ার মার্শাল এপি সিং। এরপর যৌথ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় কর্মকান্ডের ওপর ১০ মিনিটের একটি ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। সেই ভিডিও দেখে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে আশেপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। পরে সেখান থেকে ঐহিত্যবাহী খাসিয়া ফরেস্ট পরিদর্শন করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
সফরের তৃতীয় দিন (১১ মে) ভারতীয় সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। এসময় প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানান বিএসএফের মেঘালয় জোনের আইজি ইন্দ্রজিৎ সিং রানা। পরে আলোচনা সভায় মুক্তিকালীন স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিব, মেজর জেনারেল (অব.) জি কে দাশ, ফারুক আহমেদ। সভায় মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া বিএসএফ সদস্য বিসি রায় বক্তব্য তুলে ধরেন। এরআগে সৌন্দর্যে ভরপুর মায়াবী ওয়ার্ড লেক ও অ্যামিয়াম লেক পরিদর্শন করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
চতুর্থদিন (১২ মে) সকালে প্রতিনিধি দল ডন বসকানো মিউজিয়াম পরিদর্শন করেন। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত এ প্রতিনিধিদলের সম্মানে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ও নৈশভোজের আয়োজন করেন মেঘালয় রাজ্যের রাজ্যপাল। অনুষ্ঠান শুরুর আগে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন রাজ্যপাল। পরে হলরুমে আয়োজিত অনুষ্ঠানে মেঘালয় রাজ্যের সংস্কৃতিমন্ত্রী, চিফ সেক্রেটারিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। সেখানে রাজ্যপাল শ্রী সত্য পাল মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রিয়েল হিরো’ বলে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা যদি মেঘালয় ভ্রমণে আসেন, তাহলে রাজ্যপাল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেবেন ও রাজ্যপালের অতিথি হিসেবে গ্রহণ করবেন। আলোচনাকালে তিনি অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
পঞ্চমদিন (১৩ মে) প্রতিনিধিদলকে নিয়ে যাওয়া হয় চেরাপুঞ্জি। পথে রামকৃষ্ণ মিশনের আয়োজনে চা চক্রে মিলিত হয় প্রতিনিধিদল। চেরাপুঞ্জি বা সোহরা হচ্ছে শিলংয়ের মূল আকর্ষণ। সেভেন সিস্টারস ফলস, মাউসামি কেইভ, নুকায়কালী ফলস, মাউন্টেইন ভিউ সবই আছে এখানে। ভারতের স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশদের জন্য এটি একটি জনপ্রিয় পাহাড়ি রিসোর্ট ছিল। এখানে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়। তাই ঘুরতে আসলে রেইন কোর্ট বা ছাতা রাখা জরুরি। সারাদিন চেরাপুঞ্জিতে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেই প্রতিনিধিদল আবার ফিরে আসেন শিলং শহরে।
শেষদিন (১৪ মে) সকালে দেশের উদ্দেশে রওনা দেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। প্রতিনিধিদলকে নিয়ে বহনকারী গাড়িগুলো পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে সরু রাস্তা দিয়ে চলছিল ডাউকির পথে। দুপুরে ডাউকি পৌঁছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে বিদায় জানায় বিএসএফ।
বিদায়বেলায় মনে হচ্ছিল কী যেন ফেলে আসছিলেন সবাই। কারণ ছয়দিনের সফরে মেঘালয় যেন আপন থেকে আপন হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে, মেঘালয় সরকারের যারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রতিদিন ছিলেন, তারা যেন হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের এক একজন সদস্য।
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সঙ্গে অনেক বছর আগ থেকেই বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক গভীর। খাবার, সংস্কৃতি, পোশাকসহ বিভিন্ন বিষয়ে মিল রয়েছে রাজ্যগুলোর সঙ্গে। ভারতীয় দূতাবাসের এই আয়োজন রাজ্যগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।
বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে পড়াশোনা করেন এবং এসব রাজ্যের প্রচুর শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর যোগাযোগ ও সম্পর্ক যত বাড়বে, দুই দেশের মানুষ তত উপকৃত হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। শুধু উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোই নয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা জানাতে অন্যান্য রাজ্যগুলোতেও ডেলিগেশন টিম যাওয়া দরকার। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। এ সফরের মাধ্যমে যা কিছু বিনিময় হয়েছে, তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ডেলিগেশন টিমে যারা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা- হারুন হাবিব, মেজর জেনারেল (অব.) জি কে দাশ, ফারুক আহমেদ, গোলাম মওলা, সুজেত আলী, তারেকুজ্জামান, মো. আক্তারুজ্জামান, সেলিম রেজা, আবদুর সাত্তার, মো. সাইফুজ্জামান, আবদুল কাদের, আবদুর সামাদ, মোশাররফ হোসেন, আমিনুল হক, প্রসন্ন সরকার, একেএম ফজলুল হক, শংকর কর্মকার, নুরুল আনোয়ার ভূইয়া, আকরাম আলী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, সাংবাদিক বিপ্লব দে (পার্থ), আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য আরশেদুল আলম বাচ্চু, আন্তর্জাতিক উপ কমিটির সদস্য সুমন কুন্ডু, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান আল মামুন, সাংবাদিক অনয় মুখার্জী, উত্তম দাশ কাব্য।
লেখক : বিপ্লব দে (পার্থ), সাংবাদিক ও আইনজীবী
আরবিসি/০৩ জুন/ রোজি