• বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৫ অপরাহ্ন

নরসিংদীতে দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে হত্যা

Reporter Name / ২৪৭ Time View
Update : মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০২২

আরবিসি ডেস্ক : নরসিংদীর বেলাবতে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে হত্যার দায় স্বীকার করে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক লিখিত জবানবন্দি দিয়েছেন গিয়াস উদ্দিন শেখ। জবানবন্দিতে তিনি জানান, জুয়া খেলার টাকা না থাকায় তিনি হতাশা থেকে এবং স্ত্রী রহিমা বেগমের নামে এনজিওসহ বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা আত্মসাৎ করতে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পনা ছিল, এ হত্যার দায় জেঠাতো ভাই রেনু মিয়ার ওপর চাপানো। বাড়ির রাস্তার জায়গা নিয়ে রেনু মিয়ার সঙ্গে বিরোধ রয়েছে তার।

গতকাল সোমবার বিকেলে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রকিবুল হকের আদালতে মামলার একমাত্র আসামি হিসেবে এই জবানবন্দি দেন। রবিবার রাতে নিহত রহিমা বেগমের ভাই মো. মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে বেলাব থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এর আগে রবিবার সকালে উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের নিজ বাড়ি থেকে স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৬), একমাত্র ছেলে রাব্বি শেখ (১২) ও একমাত্র মেয়ে রাকিবা শেখের (৭) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গৃহকর্তা গিয়াস উদ্দিন শেখকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

জিজ্ঞাসাবাদে গিয়াস উদ্দিন ছেলের খেলার ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে ও চাকু দিয়ে কুপিয়ে হত্যার বর্ণনা দিয়ে দায় স্বীকার করে নেন। আটকের পর তাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে হত্যায় ব্যবহৃত ক্রিকেট ব্যাট ও চাকু উদ্ধার করেছে পুলিশ।

মামলার বাদী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, পাটুলী ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন শেখ। গত ১৫ বছর আগে মূল বাড়ি ছেড়ে অদূরে ৫০ হাজার টাকায় ১৫ শতাংশ জমি কিনে দুটো মাটির ঘরে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ওই বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো রাস্তা ছিল না। বাড়ি থেকে বের হতে ব্যবহার করতে হতো তারই আপন জেঠাতো ভাই রেনু মিয়ার জমি। আর তা নিয়ে প্রায়ই রেনু মিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হতো।

এদিকে, গিয়াস উদ্দিন শেখ পেশায় একজন রঙমিস্ত্রি। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করেন গাজীপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তিনি বেশিরভাগ সময় গাজীপুরেই অবস্থান করেন। আর দুই সন্তানকে নিয়ে রহিমা বেগম গ্রামের এ বাড়িতেই আলাদা ঘরে থাকতেন। রহিমা বেগম এলাকায় কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে। আর রাব্বি স্থানীয় একটি মাদরাসার ছাত্র ও রাকিবা স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতো। গাজীপুরে জুয়া খেলার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন গিয়াস। সেই আসক্তি থেকে পেশাগত কাজে ব্যবহারের কথা বলে স্ত্রীর নামে এনজিওসহ বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে প্রায় ৮-১০ লাখ টাকা ঋণ নেন। এর মধ্যে এনজিও আাশা থেকে ৮০ হাজার টাকা, টিএমএসএস থেকে ৫০ হাজার টাকা, ব্র্যাক থেকে ১ লাখ টাকা, শ্বশুড়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, শ্যালক ও মামলার বাদী মোশারফ হোসেনকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্থানীয় একজনের কাছ থেকে সুদের ওপর দেড় লাখ টাকা ঋণ নেন। এর জন্য প্রতি সপ্তাহে তাকে ৫ হাজার ৪০০ টাকা কিস্তি গুণতে হয়। সম্প্রতি তার হাতে টাকা পয়সা না থাকায় ও জুয়া খেলতে না পারায় টাকার জন্য বাড়ি থেকে দুটোর গাছ বিক্রি করে। কিন্তু গাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য জায়গা দিতে অস্বীকৃতি জানান রেনু মিয়া। সর্বশেষ গত শনিবার সকালেও রেনু মিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয় গিয়াস উদ্দিনের। ঝগড়ার একপর্যায়ে রেনু মিয়া বড় ধরনের ক্ষতি করার হুমকি দেন। তারপরই হিসাব-নিকাশ কষে রেনু মিয়াকে ফাঁসাতে ও স্ত্রীর নামে নেওয়া ঋণের টাকা আত্মসাৎ করতে হত্যার পরিকল্পনা করেন গিয়াস উদ্দিন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি তার কর্মস্থল ও বাড়ির লোকজনকে গাজিপুর চলে যাওয়ার কথা জানান। কিন্তু তিনি বাড়িতেই ছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় রাত ১০টার দিকে বাড়ির দক্ষিণ ঘরে রাব্বি ও রাকিবা এবং পশ্চিম ঘরে স্ত্রী রহিমাকে নিয়ে শুয়ে পড়েন। রাত আড়াইটার দিকে গিয়াস উদ্দিন ছেলের ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে প্রথমে ঘুমন্ত রহিমার মাথার এক পাশে সজোরে আঘাত করেন। পরে চিৎকার দিলে মাথার অপর পাশে পুনরায় পরপর দুটো আঘাত করেন। তারপর খাট থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ব্যাট দিয়ে গলায় চাপ দিয়ে ধরে চাকু দিয়ে বুকের মধ্যে কোপান। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর গিয়াস চিন্তা করেন, ছেলে-মেয়েরা বাড়িতে অবস্থান করার বিষয়টি জানায় তাৎক্ষণিক তাদেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাট দিয়ে প্রথমে ছেলে ও মেয়েকে মাথায়, ঘাড়ে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পিটিয়ে হত্যা করেন। পরে বাইরে থেকে দরজা আটকে রক্তমাখা ব্যাট ও চাকু নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় বাড়ির পাশে গঙ্গাজলী খালে চাকু ও পার্শ্ববর্তী দেবলার টেকের একটি ঝোপে ক্রিকেট ব্যাট লুকিয়ে রেখে হেঁটে স্থানীয় ভূইয়ার বাজারে চলে যান।

পরবর্তিতে ভোরে রিকশা নিয়ে মনোহরদী ও পরে কর্মস্থল গাজীপুরের কাপাসিয়ায় চলে যান। সকালে বাড়ি থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের লাশ উদ্ধারের ফোন পেয়ে বাড়িতে এসে কান্নাকাটির নাটক করেন। সেখানে পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদেরকে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে রেনু মিয়া হত্যা করেছে বলে প্রচার করেন। পাশাপাশি নিজে গাজীপুরে ছিলেন বলেও জানান। পিবিআই পুলিশ তার কথা সন্দেজনক মনে করে মোবাইল ট্র্যাক করে নিশ্চিত হয়, হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি বাড়িতেই ছিলেন। তখন আটক করে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি প্রাথমিকভাবে হত্যার দায় স্বীকার করেন। সোমবার সকাল ১০টায় সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রকিবুল হকের আদালতে হাজির করে জবানবন্দিও আবেদন করা হয়। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত আদালতের বিচারকের খাস কামড়ায় হত্যার বর্ণনা দিয়ে ১৬৪ ধারায় লিখিত জবানবন্দি দেন গিয়াস উদ্দিন।

বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাফায়েত হোসেন পলাশ বলেন, রাতে নিহত রহিমা ভাই শিবপুর উপজেলার জয়নগর গ্রামের কান্দাপাড়া গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে মো. মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের জন্যে পিবিআইয়ে স্থানান্তর করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক সালাহউদ্দিন বলেন, মামলার একমাত্র আসামি গিয়াসউদ্দিন শেখ স্ত্রী ও দুই শিশু সন্তানকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় লিখিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আরবিসি/২৪ মে/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category