স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর পবা ও চারঘাট উপজেলা জুড়ে তিন ফসলি কৃষি জমিতে অবৈধ ভাবে ভ্যাকু মেশিন দিয়ে পুকুর খনন করার হিড়িক পড়েছে। এমনকি বেশি লাভের আশায় আমের গাছ কেটে ভিটা জমিতে পুকুর খনন করা হচ্ছে। ভূমি আইন উপেক্ষা করে অবাধে চলছে খননকাজ। রাত দিন সমানে পুকুর খনন করায় কমে যাচ্ছে বাগানসহ তিন ফসলী জমির পরিমাণ।
পাশাপাশি মাটির চাহিদা মেটাতে সারা রাতে মাটি কেটে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে টপ সয়েল। বিক্রি করা মাটি পরিবহণের ভারি ডামট্রাক ও ট্রাক্টরের চলাচলে নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার গ্রামীণ পাকা রাস্তা সড়ক। গত কয়েকদিন আগে এই মাটির ট্রাক্টরে কারণে নওহাটায় সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন মারা যায়। যারমধ্যে একই পরিবারের শিশুকন্যাসহ স্বামী-স্ত্রী।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পবা উপজেলার বড়গাছি উত্তরপাড়ায় আলহাজ্ব মকবুল হোসেনের আমবাগান মাটি লীজ নিয়ে হচ্ছে পুকুরখনন। ওই এলাকার বরাবরে যারা পুকুরখনন করে তারাই কাটছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নেই কমবেশী হারে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
রাজশাহীতে পুকুর খননের কারণে আবাদি জমি কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের জন্য ধানের যে জমি কমেছে এরচেয়ে বেশী ক্ষতি হচ্ছে আবাদে। জলাবদ্ধতার কারণে এক তৃতীয়াংশ জমি অনাবাদি হয়ে পরিত্যাক্ত জমিতে পরিণত হচ্ছে। গত ১০ বছরে বোরো ধানের জমি কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। পবা উপজেলার মত রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলেও শুরু হয়েছে পুকুরখনন। এক সময় বোরো ধানের জন্য বিখ্যাত হলেও, এখন সেই খ্যাতি আর নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলাকাবাসী বলেন, এখানে পুকুরখনন হলে বর্ষার পানি বেরুতে পারবে না। একটু বৃষ্টি হলেই এলাকা ডুবে যাবে। বড়গাছি উত্তরপাড়ার বৃদ্ধা সাহেরা বেগম তিনি কাটা গাছের ঝরা পাতা কুড়াতে কুড়াতে জানান এখানে ৫০-৬০টি আমগাছ ছিল। একে একে সবগাছ কাটা হচ্ছে। পুলিশ আসলে কাজ বন্ধ থাকে। চলে গেলে রাত-দিন চলতে থাকে।
এদিকে চারঘাট উপজেলার সলুয়া ইউনিয়নের হলিদাগাছী জায়গীরপাড়া সংলগ্ন বিলে প্রায় ২০ বিঘা আয়তনের তিন ফসলী জমি নষ্ট করে পুকুর খনন হচ্ছে। পুকুরখনন করছেন হলিদাগাছী সরকারপাড়া এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন সরকার ও একই এলাকার জাফর হক কচি।
স্থানীয় কৃষকেরা অভিযোগ করে বলেন, তাদের অনুমতি ছাড়াই ভুট্টা, আখ ও পাটক্ষেতের ফসল নষ্ট করে ভেকু নিয়ে গেছে প্রায় ১ থেকে ২ কিলোমিটার। কিছু বলতে গেলে কৃষকদেরকে নাহিদ ও শান্ত নামে দুই ব্যক্তি হুমকি ধামকী দিচ্ছে এবং পুকুরের মাটি পরিবহন করে বিক্রি করার লক্ষে রাস্তা দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে বলেও অভিযোগ করেন কৃষকগণ।
পুকুর খনন বিষয়ে জমির মালিক শাহবুদ্দিন সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি একজন প্রিন্সিপাল ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। জামাত-বিএনপি’র লোকেরা পুকুর খনন করতে পারলে আমি পারবো না কেন? তাই আমার জমিতে আমি পুকুর খনন করছি। কৃষকের জমির ফসল নষ্ট করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি এটা জানিনা।
এ বিষয়ে পুকুর লিজ নেওয়া আবু জাফর কচি বলেন, তিনি সলুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের লোকজনকে পুকুর খনন ও মাটি পরিবহনের দায়িত্ব দিয়েছেন। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন যেভাবে বাড়ছে, সামনে আরো বেশি পরিমাণ জমির ফসল নষ্ট হবে। আর এই পুকুর খননের কারনে বন্ধ হবে বিলের পানি নিষ্কাশনের নালা।
আমবাগান, তিন ফসলি ও ধানের জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে পারছেনা প্রশাসন। বর্তমানে রাজশাহীর খালে বিলে যেদিকে চোখ যায় শুধু বোরো জমিতে দেখা মেলে পুকুর আর পুকুর। এখন বোরো জমি বাদেও তিন ফসলি ও বিভিন্ন ফলদ বাগান ধ্বংস করে তা পুকুরে পরিণত করা হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। গত দশ বছর ধরে এই এলাকায় চলছে পুকুর খননের হিড়িক।
এই পুকুর খননের বিষয়ে জেলা প্রশাসন দুষছেন উপজেলা প্রশাসনকে, আবার উপজেলা প্রশাসন দুষছেন জেলা প্রশাসনকে। জেলা প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে সব ধরনের পুকুর খননের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাজারী রয়েছে। তারপরও উপজেলা প্রশাসনের মদদে ও উদাসিনতার কারণে বারবার একই ব্যক্তিরা ফসলী ও বোরোর জমিতে পুকুর খনন করে চলেছে।
এ ক্ষেত্রে আবার উপজেলা প্রশাসন, বলছেন থানার সহযোগিতায় পুকুর খনন করা হয়। আর পুকুর খননকারীরা বলছেন, পুকুর খনন করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও থানা শেষে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনকল্যাণে পুকুর খনন নয়, মাটি বিক্রির জন্যই এই পুকুরখননের হিড়িক।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ সামিরা ইসলাম বলেন, অভিযোগ ও তথ্য যদি সঠিক হলে তদন্ত করে পুকুর খননকারীর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরবিসি/২০ মে/ রোজি