আরবিসি ডেস্ক : একবার ভাবুন তো, আপনার হাত-পা বেঁধে আপনাকে কাতুকুতু দেওয়া হচ্ছে। এবং আপনি হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছেন! ব্যাপারটা শুনতে অনেক চমকপ্রদ মনে হচ্ছে না? প্রকৃত অর্থে কিন্তু তা না। কেউ আপনার হাত-পা বেঁধে ক্রমাগত কাতুকুতু দিলে তা হবে প্রচণ্ড বেদনার, কষ্টের।
হাসি না পেলেও হাসতে হবে, এর চেয়ে বিড়ম্বনার আর কিইবা হতে পারে। আবার সেই হাসি অনেক সময় হয়ে ওঠে মৃত্যুর কারণ।
সুকুমার রায়ের মুলুকে স্বরচিত গল্প শোনানোর জন্য এমন জোরজুলুম ছিল কাতুকুতু বুড়োর। জোর করে হাসাতে লম্বা পালক দিয়ে গায়ে সুড়সু়ড়িও দিতেন সেই সর্বনেশে বুড়ো। এ অত্যাচার রক্তপাতহীন। এমনকি, অত্যাচারের চিহ্ন পর্যন্ত থাকে না দেহে।
নানা দেশেই যুগ যুগ ধরে বন্দিদের ওপর অত্যাচারে নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে এই চিনে দাওয়াই। জেরার সময় বন্দিদের হাত-পা বেঁধে তাদের ওপর কাতুকাতুর অত্যাচার চালানো হত। তার জেরে মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে বন্দিদের।
শারীরিক হেনস্থা বা অপমান করা অথবা দমিয়ে রাখার জন্যও এককালে অভিজাতরা কাতুকুতুর দাওয়াই দিয়েছেন তাদের প্রজাদের। চীনের হান বংশের রাজত্বকালে এই পন্থা নেওয়া হলেও কালে কালে তা ছড়িয়ে পড়েছে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ইতালি থেকে জার্মানির মতো নানা দেশে।
আমেরিকার লেখক ক্যারোলিন হাস্ক একবার লিখেছিলেন, কাতুকুতু মোটেও হাসির বিষয় নয়। যথার্থই বলেছেন ক্যারোলিন। অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছে গেলে কাতুকুতু মোটেও হাসি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে না। জোর করে কাতুকুতু দেওয়া হলে বমি করা বা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়তে পারেন অনেকে। নাৎসি জার্মানিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কাতুকুতুর অত্যাচারে বন্দির মৃত্যুও হয়েছে।
২০৬ খ্রিস্টপূর্বে চীনের হান সাম্রাজ্যে কাতুকুতুকে হাতিয়ার করেই প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতেন অভিজাতরা। কারণ, এ অত্যাচারের চিহ্ন ধরা পড়ে না প্রজাদের দেহে। অন্যদিকে, অত্যাচারের পর সহজেই তার প্রভাবমুক্ত হতে পারতেন বন্দিরা।
চীনের গণ্ডি পেরিয়ে এই দাওয়াই কীভাবে অন্য দেশে পৌঁছাল, তা স্পষ্ট জানা যায় না। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার ফায়দা তুলেছিলেন নাৎসিরা। সমকামী হওয়ার ‘অপরাধে’ জোসেফ কহোয়াট নামে এক অস্ট্রিয়ানকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করেছিলেন তারা।
জোসেফের দাবি, ফ্লোসেনবার্গের শিবিরে থাকাকালীন তিনি দেখেছিলেন কীভাবে বন্দিদের ওপর কাতুকুতুর অত্যাচার চালাতেন রক্ষীরা। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য মেন উইথ দ্য পিঙ্ক ট্রায়াঙ্গল’-এ জোসেফের কাহিনী তুলে ধরেছিলেন হান্স নিউম্যান। হাইঞ্জ হেগার নামে ছদ্মনামে লেখা ওই বইয়েও জোসেফের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা ধরা পড়েছে।
ইউরোপের অন্য দেশেও এই চীনে দাওয়াই ব্যবহার হয়েছে। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ তার খুঁটিনাটি তথ্য পাওয়া যায়। ইটালিতে জেলবন্দিদের হাত-পা বেঁধে তাদের পায়ে নুন-পানি মাখিয়ে দিতেন। তারপর বন্দিদের শুইয়ে তাদের সামনে ছেড়ে দেওয়া হত একটি ছাগলকে।
বন্দিদের পায়ে মাখানো সেই নুন-পানি ছাগলে চেটে খেতে শুরু করলে প্রথমে কাতুকুতুর অনুভূতি হত। তবে ক্রমাগত পা চাটতে থাকায় এক সময় সেই পা শুকিয়ে উঠত। তারপর বন্দিদের পায়ে ফের এক প্রস্থ নুন-পানি মাখানো হত। তখনই অস্বস্তিতে পড়তেন বন্দিরা। বার বার এই পদ্ধতিতে বন্দিদের ওপর অত্যাচার চলত।
১৫০২ সালে ফ্রানসিসকাস ব্রুনাস দি সান সেভেরিনো নামে এক ইটালীয় জুরি তথা সন্ন্যাসীর বইয়ে এই পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে। যদিও বাস্তবেই এভাবে অত্যাচার চলত না কি তা ব্রুনাসের কল্পনাপ্রসূত, তা নিয়ে তর্ক রয়েছে। অনেকের দাবি, অত্যাচারের ভুক্তভোগী খোদ ব্রুনাস।
প্রাচীন জাপানেও পৌঁছে গিয়েছিল চীনে দাওয়াই। ‘শিকেই’ নামে ওই দাওয়াইয়ের অঙ্গ হিসেবে অপরাধীদের নির্দয়ভাবে কাতুকুতু দেওয়া হত।
প্রাচীন ইংল্যান্ডে এবং বিংশ শতকে আমেরিকায় কাতুকুতুর অত্যাচারের কয়েকটি ঘটনা শোনা গিয়েছে।
আরবিসি/২৩ এপ্রিল/মানিক