• রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২৪ অপরাহ্ন

২০ বছর ধরেই বেপরোয়া অপারেটর শাখাওয়াত

Reporter Name / ৬৯ Time View
Update : শুক্রবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২২

স্টাফ রিপোর্টার : বরেন্দ্র বহুমূখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) দুই নেতার ইন্ধনে প্রায় ২০ বছর ধরে গভীর নলকূপ চালাচ্ছিলেন সেই শাখাওয়াত হোসেন। সেচের পানি নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। কয়েকদফা লিখিত অভিযোগ দিয়েও তাকে নড়াতে পারেননি কৃষকরা। পানি না পেয়ে দুই কৃষকের আত্মহননের পর সামনে এসেছে এসব অভিযোগ।

অভিযোগ উঠেছে, এই অপারেটরের খুঁটির জোর বিএমডিএ কেন্দ্রীয় কর্মচারী লীগের (রাজ-৩০৪২) সভাপতি মেসবাউল হক এবং বিএমডিএ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিএফএম হাসনুল ইসলাম। এই দুই নেতার ইন্ধনে সেচের পানি নিয়ে শুরু থেকেই বেপরোয়া ছিলেন শাখাওয়াত।

গত ২৩ মার্চ বিষ পান করেন রাজশাহী গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের নবাই বটতলা নিমঘুটু গ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মার্ডি। বাড়ি ফিরে ওই দিন রাতেই মারা যান অভিনাথ। স্বজনরা ওই রাতেই রবি মার্ডিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ মার্চ রাতে মারা যান রবিও।

এই ঘটনায় গত ২৫ মার্চ রাতে আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে অভিনাথ মার্ডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম বাদী হয়ে মামলা করেন। রবি মার্ডির মৃত্যুর পর আত্মহত্যার প্ররোচনায় আরেকটি মামলা করেন তার ভাই সুশীল মার্ডি। দুটি মামলাতেই একমাত্র আসামি গভীর নলকূপ অপারেটর শাখাওয়াত হোসেন। স্বজনদের দাবি, অপারেটর ধানখেতে পানি না দেওয়ায় বিষপান করেন দুই কৃষক।
১১ দিন পলাতক থাকার পর ২ এপ্রিল গ্রেফতার হন শাখাওয়াত। বর্তমানে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন। গত ৬ ও ৭ এপ্রিল কারাফটকে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। কিন্তু দুই কৃষকের আত্মহননের বিষয়ে তেমন কিছুই তার মুখ থেকে বের করা যায়নি। ফলে মরদেহের ভিসেরা প্রতিবেদনের দিকেই এখন চোখ পুলিশের।

এদিকে দুই কৃষকের ঘটনা সামনে আসায় অভিযোগ তদন্ত করেছে বিএমডিএ। তারা অপারেটরের বেশ কিছু অনিয়মও পেয়েছে। এরপরই শাখাওয়াত হোসেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়। এই কাণ্ডে অপারেটর শাখাওয়াত হোসেনের শাস্তি দাবিতে সংখ্যালঘু সংগঠনগুলো লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচিও চালিয়ে যাচ্ছে। এতো কিছুর পরও ওই অপারেটরের শাস্তি নিয়ে সন্দিহান আদিবাসী নেতারা ।

তারা বলছেন, বিএমডিএর কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর ইন্ধনে বেপরোয়া ছিলেন শাখাওয়াত। তারাই এখন তাকে বাঁচাতে মরিয়া। সর্বশেষ গত মঙ্গলার বিএমডিএ চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাতে এই বিষয়টিও তারা জানিয়েছেন।

বিএমডিএ সূত্র জানাচ্ছে, ২০০২ সালে গোদাগাড়ী-২ এর আওতায় ঈশ্বরীপুর-২ গভীর নলকূপটি বসানো হয়। শর্ত সাপেক্ষে সেখানে অপারেটরের দায়িত্বপান শাখাওয়াত হোসেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে গভীর নলকূপটি চালাচ্ছিলেন শাখাওয়াত।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শাখাওয়াত হোসেন বিএমডিএ সিবিএ নেতা মেসবাউল হকের মামাতো বোনের ছেলে। এ ছাড়া তিনি বিএমডিএ ডিপ্লোমা ইঞ্জিজিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জিএমএফ হাসনুল ইসলাম ফারুকের কাছের মানুষ। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই দুই শীর্ষ নেতার বাড়ি গোদাগাড়ীতেই।

এ ছাড়া ২০০২ সালের দিকে উপসহাকারী প্রকৌশলী হিসেবে ওই জোনে দায়িত্বে ছিলেন হাসনুল ইসলাম। সহকারী প্রকৌশলী হিসেবেও ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জোন প্রধানের দায়িত্বপালন করেন। ওই সময় চেক জালিয়াতি করে বিএমডিএ প্রায় ৫৯ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে হাসনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এই কাণ্ডে তার সহযোগী ছিলেন আরেক সহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন।

দুই দফা তদন্ত করে এই দুইজনের সম্পৃক্ততা পায় বিএমডিএ। শেষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও অর্থ আত্মসাতে এই দুজনের সম্পৃক্ততা উঠে আসে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ ছিল মন্ত্রণালয়ের। এরপরও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তারা। হাসনুল ইসলাম নওগাঁ রিজিওনে কর্মরত। এর আগে রাজশাহীর মোহনপুর এবং নওগাঁর রাণীনগরে দায়িত্বপালন করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে এই দুই এলাকাতেও অর্থের বিনিময়ে এসটিডাব্লিউ স্থাপনসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধান বলছে, শুরুর দিকে শাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ ছিল না। কিন্তু সময় যতই গড়িয়েছে, ততই ভারী হয়েছে অভিযোগের পাল্লা। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে সেচের পানি সরবরাহে গাফিলতির অভিযোগ করে আসছিলেন কৃষকরা। কিন্তু বিএমডিএ সেসব অভিযোগ কানে তোলেনি বিএমডিএ।

সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে বিএমডিএর জোন অফিসে অপারেটর শাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। তাতে উল্লেখ করা হয়, অপারেটর শাখাওয়াত সময়মতো কৃষকদের জমিতে পানি সরবরাহ করেন না। অকারণে দিনের পর দিন পানি সরবরাহ বন্ধ রেখে সেচ ও খাবার পানির সংকট সৃষ্টি করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে অপারেটরের দায়িত্ব থেকে তার অপসারণ চেয়ে একজন নারী কৃষকের নাম প্রস্তাব করা হয়। একই ধরণের অভিযোগ দেওয়া হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে।

সর্বশেষ অভিযোগ পাবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএমডিএর গোদাগাড়ী জোন-২ এর সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল হাসান। তিনি বলেন, মূলত: গোদাগাড়ী জোন-১ এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তিনি। কিন্তু ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে জোন-২ এ তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার দপ্তরে অপারেটরের বিরুদ্ধে একটা লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছিল। ওই সময় তিনি জোন-১ এর দপ্তরে ছিলেন। পরে অভিযোগটি নিয়ম মাফিক রিজিওনে পাঠানো হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, লিখিত অভিযোগ জমা পড়ার পরই অপারেটর শাখাওয়াত হোসেনকে রক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠেন সিবিএ নেতা মেসবাউল হক। তিনি শাখাওয়াতকে সঙ্গে নিয়ে রিজিওন প্রধান জিন্নুরাইন খানের সঙ্গে সাক্ষাতও করেন। তাদের সঙ্গে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী নেতা হাসনুল ইসলামও ছিলেন। তিনি সাফাই গান শাখাওয়াতের পক্ষে। ফলে সেই যাত্রায় টিকে যান শাখাওয়াত। মূলত: এরপর থেকেই আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই অপারেটর।

বিএমডিএ রাজশাহী রিজিওনের নির্বাহী প্রকৌশলী জিন্নুরাইন খান বলেন, সাধারণত কোনো অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে জোন অফিস থেকে মেকানিক-উপসহকারী প্রকৌশলীরা তদন্তে যান। এক্ষেত্রেও সেটি হয়েছিল। কিন্তু সেইভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

আরবিসি/১৫ এপ্রিল/ রোজি

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category