আরবিসি ডেস্ক : দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশ দলকে আটকানোর সাধ্য কার? এই তো কদিন আগেই ক্রিকেট পরাশক্তি ভারত দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে রীতিমত নাকানিচুবানি খেয়ে ফেরে। সিরিজ হারে ০-৩ ব্যবধানে। এবার সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে বাজিমাত বাংলাদেশের। তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ম্যাচ ৯ উইকেটে জিতে প্রথমবারের মতো সে দেশে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেয়েছে টাইগাররা। এই সফরের প্রথম ম্যাচ বাংলাদেশ ৩৮ রানে জয়ের আগে কজনই বা ভেবেছিল এমনও হতে পারে!
সেঞ্চুরিয়ানে প্রথম ম্যাচ জয়ের পর অবশ্য জোহানেসবার্গে দ্বিতীয় ম্যাচ হেরে যায় বাংলাদেশ। বুধবার সিরিজ নির্ধারণী অলিখিত ফাইনালে বাজিমাত তামিম ইকবালের দলের। টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে তাসকিনের বিধ্বংসী বোলিংয়ে ১৫৪ রানেই গুটিয়ে যায় প্রোটিয়ারা। ১৫৫ রানের লক্ষ্য টপকাতে নেমে তামিমের ফিফটি আর লিটন দাসের অনবদ্য ব্যাটিংয়ে ৯ উইকেট আর ১৪১ বল হাতে রেখে বিশাল জয় পেয়েছে টাইগাররা। সঙ্গে সুপার লিগের গুরুত্বপূর্ণ ১০ পয়েন্ট যোগ হয়েছে বাংলাদেশের নামে।
তাসকিনের ৫ উইকেটের পর প্রতিপক্ষকে ১৫৪ রানে গুটিয়ে দিয়ে যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে বাংলাদেশ, সে আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার সফরকারী বোলাররা। অনেক সময় লো স্কোরিং ম্যাচ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তালগোল পাকিয়ে ম্যাচ হেরে বসে পরে ব্যাট করা দল। এই সফরের আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ তো দূর, কোনো ম্যাচ না জেতা বাংলাদেশ যে সেটি করতে পারে, সেই শঙ্কা জমাট বেঁধেছিল। তবে তামিম-লিটনের ‘নির্ভার’ ব্যাটিং সব শঙ্কা তুড়িতে উড়িয়ে দিয়েছে।
যদিও বিপদটা হতে পারতো শুরুতেই। রান তাড়ায় প্রথম ওভারেই উইকেট হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ। ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন লিটন। কাগিসো রাবাদার অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান। পয়েন্টে বল মুঠোয় জমাতে পারেননি কেশভ মহারাজ। তখন শূন্য রানে ব্যাট করছিলেন লিটন। সেই লিটন পরে ফিরেছেন আক্ষেপ সঙ্গী করে, ৪৮ রানে। ২ রানের জন্য অর্ধশতক করতে পারেননি এই ডানহাতি।
লিটন না পারলেও ফিফটি তুলে নেন তামিম। স্ট্রাইক রেটের জন্য সমালোচিত বাঁহাতি ওপেনার আজ হাত খুলে খেলেছেন। দলীয় রান যখন ৭৩, তখন ব্যক্তিগত ফিফটি তামিমের। সেটিও আসে মাত্র ৫২ বলে, ৯টি চারের মারে। তামিমের মতো লিটনও ছুঁটছিলেন ফিফটির দিকে। তবে ইনিংসের ২১তম ওভারে মাহারাজের বলে আউট হন তিনি। ফেরার আগে ৫৭ বলের ইনিংসটি সাজান ৮টি চার দিয়ে। দুই জনের ১২৭ রানের ওপেনিং জুটির পর সাকিবকে নিয়ে জয়ের বাকি আনুষ্ঠানিকতা সারেন তামিম।
৯ উইকেটে পাওয়া জয়ের পরেও খানিক আফসোসে করার জায়গা আছে তামিমের। প্রতিপক্ষ আর কিছু রান করলে সেঞ্চুরিটা পেয়ে যেতে পারতেন তিনি। তবে এমন ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের কাছে এমন আফসোস ধোপে টেকার কথা নয়। ৯ উইকেট আর ১৪১ বল হাতে রেখে পাওয়া জয়ে তামিম অপরাজিত থাকেন ৮২ বলে ৮৭ রানে। যেখানে কোনো ছয় না মারলেও বাউন্ডারি মারেন ১৪টি। সঙ্গে ২০ বলে ১৮ রানে অপরাজিত থাকেন সাকিব আল হাসান।
এর আগে টসে জিতে ব্যাট করতে নামা দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসের শুরুটা হয় বেশ দাপুটে। সেঞ্চুরিয়ানে কুইন্টন ডি ককের পরিসংখ্যান বেশ সমৃদ্ধ। আজ তাকে একপাশে রেখে ইনিংস শুরু করতে নেমে আগ্রাসী ছিল ইয়ানেমান মালামের ব্যাট। ইনিংসের প্রথম ৬ ওভারেই স্কোর বোর্ডে ৪০ রান। এই জুটি যখন ধীরে ধীরে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন দৃশ্যপটে মেহেদী হাসান মিরাজ। বিধ্বংসী হওয়ার আগে ফেরালেন ডি কককে।
মালানের সঙ্গে কাইল ভেরেইনার দ্বিতীয় উইকেটের জুটিটাও ভয় ধরাচ্ছিল। এবার দায়িত্ব নিলেন পুরোনো বলে বিধ্বংসী হয়ে ওঠা তাসকিন। ইনিংসের ১৩তম তৃতীয় বলে ফেরালেন ভেরেইনাকে। অফ স্টাম্পের বাইরের বল ড্রাইভ করেন ভেরেইনা। বল তার ব্যাটে লেগে ভেঙে দেয় স্টাম্প। ১৬ বলে একটি চারে ভেরেইনা করেন ৯ রান। এই উইকেটের পরেই যেন মোমেন্টাম পেয়ে যায় সফরকারী শিবির। ৬৬ রানে ১ উইকেট থেকে ৮৩ রানে পাঁচ! ১৭ রানে নেই ৪ উইকেট।
ভেরেইনাকে আউট করার পর তাসকিন ফেরান ওপেনার মালানকে। ডানহাতি পেসারকে বাড়তি বাউন্স পাওয়া বল মালানের ব্যাটে ছুঁয়ে জমা পড়ে মুশফিকুর রহিমের গ্লাভসে। ৫৬ বলে ৭ চারে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান করেন ৩৯ রান।
পারিবারিক জটিলতায় জর্জরিত সাকিব ফেরান প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে। এলবিডব্লিউয়ের হয়ে ১১ বলে করেন ২ রান করে বিদায় নেন টেম্বা বাভুমা। সাকিবের পর সাফল্য পান শরিফুল ইসলাম। নিজের দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে প্রথম বলেই দারুণ এক ডেলিভারিতে আউট করেন রাসি ফন ডার ডুসেনকে। এই প্রোটিয়া করেন ৪ রান।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে ডাক পেয়েও খেলতে না যাওয়া তাসকিন দেশের জন্য কতটা নিবেদিত তার প্রমাণ দিলেই মাঠেই। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে স্বাগতিকদের পরের ৩ উইকেট তুলে নিয়ে নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ উইকেটের স্বাদ পান তিনি। একে একে ফেরান ডোয়াইন প্রিটোরিয়াস (২০), ডেভিড মিলার (১৬) আর কাগিসো রাবাদাকে (৪)। রাবাদাকে ফিরিয়ে পাঁচ উইকেটের কোটা পূর্ণ করেন তাসকিন। ১২৬ রানে ৮ উইকেট হারানো দলটি শেষদিকে কেশভ মহারাজের ২৭ রানের পরেও গুটিয়ে যায় ১৫৪ রানে। তামিম-লিটন-সাকিবের সাবলীল ব্যাটিংয়ে যা হেসে খেলেই তাড়া করে ফেলে বাংলাদেশ। গড়ে ফেলে ইতিহাস।
এই জয়ের ফলে সুপার লিগে নিজেদের নামের পাশে গুরুত্বপূর্ণ আরো ১০ পয়েন্ট যোগ করল বাংলাদেশ দল। ১৮ ম্যাচে ১২ ম্যাচে ১২০ পয়েন্ট লাল-সবুজের প্রতিনিধিদের। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইংল্যান্ড বাংলাদেশের চেয়ে ২৫ পয়েন্ট পিছিয়ে।
আরবিসি/২৩ মার্চ/ রোজি