• বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩০ অপরাহ্ন

দুই মাসে সড়কে ঝরেছে ১০১২ প্রাণ

Reporter Name / ৮৭ Time View
Update : শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২

আরবিসি ডেস্ক: গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮৪৮টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১২ জন এবং আহত হয়েছে ১ হাজার ১৪৬ জন। নিহতদের মধ্যে নারী ১৪৩ জন এবং শিশু ১৩০টি। এই সময়ে আরও ১২টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত এবং ২৬টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩৫ জন নিহত ও ছয় জন আহত হয়েছেন।

শনিবার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এ তথ্য প্রকাশ করেছে। দেশের শীর্ষ সাতটি জাতীয় দৈনিক, পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, এই দুই মাসে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই ঘটেছে ৩৫৮টি, যা মোট দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ২১ শতাংশ। এতে নিহত হয়েছেন ৪০৩ জন, যা মোট নিহতের ৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যু ১ হাজার ১২ জনের ২০২ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ১৪৭ জন, অর্থাৎ ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা পর্যালোচনায় রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় গত ২ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৭ দশমিক ১৫ জন নিহত হয়েছে। জানুয়ারি মাসে ৪৩১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৪৩ জন নিহত হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৪১৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৪৬৯ জন। এই হিসাবে জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৭ দশমিক ১২ শতাংশ এবং প্রাণহানি কমেছে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

জানুয়ারি মাসে ১৮৭ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২১৬ জন নিহত হয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে ১৭১ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৮৭ জন। উল্লেখ্য, জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাণহানি সামান্য কমলেও এটি কোনো টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না। দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮৩২ জন, অর্থাৎ ৮২.২১ শতাংশ।

ট্রাক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ড্রাইভারদের বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালানো এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। পথচারী নিহতের মাত্রাও চরম উদ্বেগজনক পর্যায়ে। পথচারীরা যেমন সড়কে নিয়ম মেনে চলে না, তেমনি যানবাহনগুলোও বেপরোয়া গতিতে চলে। ফলে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

সংগঠনটি বলছে, এই প্রেক্ষাপটে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী নিহত হয়েছেন ৪০৩ জন (৩৯ দশমিক ৮২ শতাংশ), বাস যাত্রী ৬৬ জন (৬ দশমিক ৫২ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি যাত্রী ৫৭ জন (৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ), মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স যাত্রী ২৫ জন (২ দশমিক ৪৭ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ১৮১ জন (১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-মাহিন্দ্র-টমটম-চান্দের গাড়ি-ডাম্পার-পাওয়ারটিলার) ৪৮ জন (৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল আরোহী ৩০ জন (২ দশমিক ৯৬ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৩৫৩টি (৪১ দশমিক ৬২ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ২৯৫টি (৩৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ১৪৩টি (১৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৪৬টি (৫ দশমিক ৪২ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ১১টি (১ দশমিক ২৯ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনাগুলোর ১৫১টি (১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৩৭৯টি (৪৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৯৯টি (২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ৯৩টি (১০ দশমিক ৯৬ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ২৬টি (৩ দশমিক ০৬ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ ২৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রামট্রাক-কার্গো ট্রাক-ডাম্পার-ভেম্পার-মিকচার মেশিনগাড়ি ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-এ্যাম্বুলেন্স-পুলিশ পিকআপ-আর্মি ট্রাক ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৬ দশমিক ০৯ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-হিউম্যান হলার) ১৪ দশমিক ০৫ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন- (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-পাওয়ারটিলার-মাহিন্দ্র-টমটম-ঠ্যালাগাড়ি) ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ২ দশমিক ১৫ শতাংশ।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১ হাজার ৪৩৭ টি। (ট্রাক ৩০২, বাস ১৬৮, কাভার্ডভ্যান ৩০, পিকআপ ৭৯, ট্রলি ২৮, লরি ২৩, ট্রাক্টর ৪৫, ভেম্পার ২, ডাম্পার ৪, মিকচার মেশিন গাড়ি ২, ড্রামট্রাক ৭, কার্গো ট্রাক ১, পুলিশ পিকআপ ১, আর্মি ট্রাক ১, মাইক্রোবাস ২১, প্রাইভেটকার ২৬, এ্যাম্বুলেন্স ৮, মোটরসাইকেল ৩৭৫, থ্রি-হুইলার ২০২(ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-হিউম্যান হলার), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৮১ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-পাওয়ারটিলার-মাহিন্দ্র-টমটম-ঠ্যালাগাড়ি) এবং প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান-বাইসাইকেল ৩১টি।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে ভোরে ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, সকালে ৩১ দশমিক ৪৮ শতাংশ, দুপুরে ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বিকালে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ১২ দশমিক ০২ শতাংশ এবং রাতে ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।

দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৩ দশমিক ২৩ শতাংশ, প্রাণহানি ২২ দশমিক ৭২ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১৯ দশমিক ০৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ, প্রাণহানি ২২ দশমিক ৮২ শতাংশ, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ, প্রাণহানি ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, প্রাণহানি ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, প্রাণহানি ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৭ দশমিক ২১ শতাংশ ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে, ২৩১ জন। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে, ৪২ জন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে, ৪৮ জন। সবচেয়ে কম সাতক্ষীরা জেলায়, ২ জন। রাজধানী ঢাকায় ২১টি দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ১১ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ২৭ জন, চিকিৎসক ৩ জন, পল্লী চিকিৎসক ৪ জন, স্বাস্থ্যকর্মী ২ জন, খাদ্য কর্মকর্তা ১ জন, ভূমি কর্মকর্তা ১ জন, সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা ১ জন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সাংবাদিক ৬ জন, কৃতি ফুটবলার ১ জন, সাবেক কৃতি ক্রিকেটার ১ জন, বাউল শিল্পী ১ জন, পিএইচপি গ্রুপের প্রধান প্রকৌশলী ১ জন, গ্রামীণ ব্যাংকের ৩ জনসহ বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা ১১ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৮ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ৫৪ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৪৬ জন, পোশাক শ্রমিক ১৯ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৮ জন, ইটভাটা শ্রমিক ৩ জন, কাঠমিস্ত্রি ৩ জন, রাজমিস্ত্রি ৪ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ১ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ৫ জন, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ২৩ জন এবং ঢাকা, রাজশাহী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন ছাত্রসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

প্রতিবেদনে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার ১০টি প্রদান কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; বেপরোয়া গতি; চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা এবং মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল।
এছাড়াও তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি এবং গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজিকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুর্ঘটনা রোধে ১০ দফা সুপারিশ জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা রোধে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে।
সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

আরবিসি/০৫ মার্চ/ রোজি

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category