আরবিসি ডেস্ক : ‘মাইলেজ’ পাওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফরা। এজন্য কাজে যোগদানও বন্ধ রেখেছিলেন তারা। দাবি আদায়ে স্টেশনগুলোতে তাদের বিক্ষোভে বেশ কিছু যাত্রীবাহী মেইল, কমিউটার লোকাল ট্রেন এবং তেলবাহী, কন্টেইনারবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। স্টাফদের সেই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে রেলওয়ে, এ জন্য একটি সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন রানিং স্টাফরা।
রেলওয়ে কর্মচারীদের দেড়শ বছরের পুরোনো বেতনকাঠামো পরিবর্তন করে মাইলেজ ও অতিরিক্ত পেনশন ভাতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে; এমন অভিযোগ এনে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন তারা। আন্দোলনের কারণে এরই মধ্যে হঠাৎ বিভিন্ন রুটে কিছু ট্রেন বন্ধও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলে জনবল সংকটের কারণে নির্ধারিত ডিউটির চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হয় স্টাফদের। আর বেশি সময়ের জন্য তাদের অতিরিক্ত ভাতাও দিতো সরকার। তবে গত ৩ নভেম্বর হঠাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের এ সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মবিরতিসহ আন্দোলন শুরু করেন রানিং স্টাফরা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব শামীম বানু শান্তি স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলন্ত ট্রেনে দৈনিক ১০০ কিলোমিটার কিংবা তার চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করলেও ওই দিনের বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি মাইলেজ ভাতা পাবেন না সংশ্লিষ্ট রানিং স্টাফ। আর মাস শেষে এ মাইলেজ মূল বেতনের বেশি হবে না। এ প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট দফতরে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন রেলের রানিং স্টাফরা।
রেলওয়ে আইনের ১৬৮৫/১০৮৫ বিধিতে বলা হয়েছে, ট্রেনচালক, গার্ড ও ট্রেন টিকিট পরীক্ষকেরা (টিটিই) হলেন রানিং স্টাফ। তারা নির্ধারিত ডিউটির পাশাপাশি কর্মরত অবস্থায় যত দূরত্ব পর্যন্ত ট্রেন চালাবেন, সে হিসাবে মাইল গুণে বাড়তি ভাতা পাবেন। এ আইনে সাপ্তাহিক বা সরকারি বন্ধের দিনে ডিউটি করলে ‘হলিডে মাইলেজ’ প্রাপ্তির বিধানও রয়েছে তাদের। ‘রেলওয়ে এস্টাবলিশমেন্ট কোড ভলিউম-১’-এর চ্যাপটার-৫ এবং ‘লোকোমোটিভ অ্যান্ড রানিং শেড ম্যানুয়াল জিআই চ্যাপটার-১২’ অনুযায়ী-১০০ মাইল কিংবা ৮ ঘণ্টার বেশি ট্রেন চালালে একজন রানিং স্টাফ মাইলেজ (রানিং ভাতা) প্রাপ্য হবেন। অতিরিক্ত ট্রেন চালালে প্রতি ঘণ্টা ও মাইল অনুযায়ী একদিনের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ মাইলেজ হিসেবে পাবেন তিনি।
রেলওয়ে আইন অনুযায়ী, রানিং স্টাফদের ছুটি, পাস, চিত্তবিনোদন ও অবসরোত্তর সুবিধা তাদের মূল বেতনের ৭৫ শতাংশ যোগ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু নতুন নিয়মে রেলওয়ে রানিং স্টাফদের এসব সুবিধা না থাকায় তারা ক্ষুব্ধ হন।
দাবি আদায়ে গত মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদ। মঙ্গলবার রাতেই নির্দিষ্ট এসব ট্রেনের যাত্রা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। স্টাফদের দাবি, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা দায়িত্ব পালন করলে মাইলেজ দিতে হবে। রেলের রানিং স্টাফদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেনচালক (লোকো মাস্টার), গার্ড ও টিকিট টেকার (টিটি), গার্ড (ট্রেন পরিচালক) ও টিটিই (ট্রাভেলিং টিকিট এক্সামিনার)।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ রেলওয়ের রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারি সমিতির প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর। রবিবার (৩০ জানুয়ারি) রাতে রেলভবনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে- পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা পূর্বের মতো প্রাপ্তির লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তির সর্বাত্বম উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
গত বছরের ৩ নভেম্বরের আগে যে সব রানিং স্টাফ আবসরে গেছেন তাদের ক্ষেত্রে পূর্বের চলিত নিয়মানুযায়ী পেনশন ও আনুতোষিক প্রাপ্যতা নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এসময় আলোচনা ‘সফল’ হওয়ায় রানিং স্টাফদের ঘোষিত কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়।
সভায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, আমরা রেলের রানিং স্টাফদের সঙ্গে বসেছিলাম। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরাও তাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেবো। সরকারের ‘পসিবল লেভেলে’ তাদের দাবি পৌঁছে দেবো।
সভায় বাংলাদেশ রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের গত ২৪ জানুয়ারি জারিকৃত পত্রে রেলওয়ে সংস্থাপন কোডের বিধান অনুযায়ী এলাউন্স প্রাপ্যতার সম্মতি দেওয়া হয়েছে। তাই একই কোড অনুযায়ী স্বীকৃত পেনশন ও আনুতোষিক সুবিধা প্রাপ্তির জন্য অনুরোধ করছি।’
এই পেনশনের অবসরোত্তর সুবিধা জেনেই রানিং স্টাফরা চাকরিতে প্রবেশ করেছেন উল্লেখ করে বাংলাদেশ রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও লোকো মাস্টার শাহেল আলী বলেন, এদের মধ্যে চাকরির শেষ প্রান্তে এসে এখন সেই সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে তারা ক্ষুব্ধ। এই সিদ্ধান্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
একইরকম বক্তব্য গার্ডস কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক আফজাল হোসেনের। তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্ব সহকর্মীদের এই সুবিধা প্রাপ্তি দেখে আমরা চাকরিতে এসেছি। আমাদের বিশ্বাস, আমরাও এই সুবিধা পাবো।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচাল ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেন, ‘বিষয়টি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেন কোনরকম অনিশ্চয়তা না দেখা দেয়, সেজন্য গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’
আরবিসি/৩১ জানুয়ারি/ রোজি