আমরাজ্য হিসেবে খ্যাত রাজশাহীর গাছে গাছে উঁকি দিতে শুরু করেছে আমের মুকুল। প্রকৃতিতে যখন মাঘের হাওয়ার শীতের কাঁপন চলছে। তখন হাড় কাপানো শীত ভেদ করে পাতার ফাঁকে ফাঁকে এখন দেখা মিলছে আমের স্বর্ণালী মুকুলের। ইতিমধ্যে মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়াতেও শুরু করেছে প্রকৃতিতে।
রোদ-কুয়াশার লুকোচুরির মধ্যেই রাজশাহীর প্রকৃতি সাজাতে স্বর্ণালী মুকুল প্রষ্ফুটিত হচ্ছে গাছে গাছে। আমচাষিরাও এরই মধ্যে বাগান পরিচর্যায় নেমে পড়েছেন। এবার অনেক গাছে আগাম মুকুলের দেখা মিলছে। এতে চাষিরা খুশি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মৌসুম শুরুর আগে গাছে মুকুল আসা তেমনটা ভালো নয়। কারন আগেভাগে মুকুল আসায় কুঁয়াশায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে গাছে গাছে আগাম মুুকুলে চাষিরা খুশি।
মুলত: ফাগ্নুনের শুরু থেকেই রাজশাহী অঞ্চলের গাছে দেখা মিলে মুকুলের। তবে এবার মাঘের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে প্রষ্ফুটিত হতে শুরু করেছে মুকুল। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে এবার গাছগুলোতে মুকুলের সমারোহ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। চাষিরা আশা করছেন, বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে এবারও আমের বাম্পার ফলন হবে।
শুক্রবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মহানগরীর রায়পাড়া শিরোইল, ভেড়িপাড়া, পুলিশ লাইন, মেহেরচন্ডি ও ভদ্রা আবাসিক এলাকায় অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট আম গাছে মুকুল আসতে শুরু হয়েছে। সোনারাঙা সেই মুকুলের পরিমাণ কম হলেও সৌরভ ছড়াচ্ছে বাতাসে। মুকুল আসা শুরুর পর থেকেই বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
আম চাষি ও বাগান মালিকরা বলছেন, মাঘের মাঝামাঝিতে গাছে মুকুল দেখে তারা বুঝছেন, আমের মৌসুম এসে গেছে। বাগানের গাছগুলোর যত্ন নিতে পরিশ্রম শুরু করে দিয়েছেন। ভালো ফলনের আশায় জোরেশোরে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত তারা।
রাজশাহী অঞ্চলে ৩৫ থেকে ৪০ জাতের আম চাষ হয়ে থাকে। আর সারা বাংলাদেশে রয়েছে ২’শ ৫০ জাতের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ফজলী, গোপাল ভোগ, মোহন ভোগ, ন্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত, হিমসাগর, কৃষাণ ভোগ, মল্লিকা, লক্ষণা, আম্রপলি, দুধসর, দুধকলম, বিন্দাবনী, আরজান, রাণী পসন, মিশ্রীদানা, সিঁন্দুরী, আশ্বিনা সেই সঙ্গে নানা প্রকার গুটি আম। রাজশাহীতে আম বাগান রয়েছে ১৭ হাজার ৫শ ১ হেক্টর জমিতে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের সুত্র জানায়, ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় অবধি বারোমাসি বা স্থানীয় জাতের আম গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। তবে এবার জানুয়ারির শুরুতেই মুকুল আসা শুরু হয়েছে আগাম জাতের গাছে। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝিতে মুলত আম গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। এবার একটু আগেই প্রষ্ফুটিত হচ্ছে আমের মুকুল।
রাজশাহী মহানগরীর গুড়িপাড়া এলাকার আম চাষি আবদুল গফুর জানান, তার একটি আম বাগান রয়েছে। অধিকাংশ গাছেই মুকুল দেখা দিয়েছে। তাও খুব সামান্য। সম্ভাব্য মুকুলের মাথাগুলোকে পোকা মাকড়ের আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য স্প্রে করা হচ্ছে। তবে কিছুদিন থেকে ঘন কুয়াশার কারনে মুকুল কিছুটা নষ্ট হয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, এবার শেষ সময়ে শীতের প্রকোপ থাকার পরেও আমের মুকুল এসেছে। তাদের ভাষ্য, জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এলাকায় কিছু কিছু গাছে আগাম মুকুলের দেখা মিলেছে। ফাল্গুনের শুরুতেই এবার শতভাগ গাছেই প্রষ্ফুটিত হবে মুকুল। আর এক সপ্তাহের মধ্যে পাল্টে যাবে আম বাগানের চেহারা। তখন গাছে গাছে দেখা মিলবে শুধু মুকুল আর মুকুল। স্বর্ণালী মুকুলের সুবাসিত গন্ধে মুখরিত হবে রাজশাহী। তার আভাস এখনই পাওয়া যাচ্ছে রাজশাহীর প্রকৃতিতে। তাই আম প্রধান এই অঞ্চলের মানুষের এখনই সময় কাটটে শুরু করেছে আম গাছ ও মুকুলের যত্নআত্তি নিয়েই।
এদিকে এরইমধ্যে মুকুলের উকিতে গাছে গাছে মৌমাছির গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ যেন জাদুর মতো কাছে টানছে তাদের। গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় তাই চলছে মৌমাছি আর ভ্রমরের সুর-ব্যঞ্জনা। বছর ঘুরে আবারও তাই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে আম চাষিদের মন।
জেলার বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও চাষ হয়ে থাকে নানা জাতের আম। লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই আম চাষের জমি বাড়ছে। কৃষি বিভাগ জানায়, আমের ফলন নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এ বছর আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিকরাও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, রাজশাহীতে এখনও পুরোদমে আমের মুকুল আসেনি। তবে অনেক গাছেই মুকুল দেখা দিয়েছে। রাজশাহী শহর ও পাশের উপজেলার বেশকিছু বাগান ঘুরে জানা গেছে, মুকুল উকি দিতেই গাছে গাছে ছত্রাকনাশক ও ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বাগানিরা বলছেন, জানুয়ারির শেষে দিক থেকেই গাছে মুকুল দেখা দিতে শুরু করে। তবে মুকুল আসার আগে থেকেই গাছের যত্ন নিতে হয়। গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগসহ পোকামাকড় দমনে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়।
রাজশাহীর পবা উপজেলার আমচাষি ইব্রাহিম আলী বলেন, ‘আমার বাগানে দু-একটা গাছে মুকুল দেখা দিয়েছে। তবে ২০-২৫ দিনের মধ্যে সব গাছে মুকুল চলে আসবে। রাজশাহীর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও পুরোদমে গাছে মুকুল আসেনি। তবে কিছু কিছু গাছে এসেছে। এ সময় পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমাদের সাধারণ চাষিদের বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান অতি মুনাফার লোভে অতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ করাচ্ছে। এতে আমের গুণগত মান ঠিক থাকছে না।
আরবিসি/৩০ জানুয়ারি/ রোজি