আরবিসি ডেস্ক : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবে করোনা পরীক্ষায় গুরুতর জালিয়াতি ও সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বিদেশগামী যাত্রীদের নমুনা পরীক্ষায় এমন জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আগের দিন পজিটিভ হওয়া ব্যক্তিকে ১২ ঘণ্টা পরেই নেগেটিভ দেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই বিদেশগামী যাত্রীদের নেগেটিভ সনদ দেওয়া হয়েছে। ল্যাব টেকনিশিয়ানদের একটি অংশের যোগসাজশে নমুনা সংগ্রহে চুক্তিবদ্ধ রাজশাহীর একটি এনজিও এভাবে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
জানা যায়, শুধু নগরীর ১ থেকে ১৫নং ওয়ার্ডে করোনার নমুনা সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছে জাতীয় তরুণ সংঘ নামে একটি এনজিও। কিন্তু তারা জালিয়াতির মাধ্যমে বাইরের জেলার লোককেও রাজশাহী মহানগরীর বাসিন্দা দেখিয়ে ল্যাবে নমুনা পাঠিয়েছে। অথবা নমুনা ছাড়াই ল্যাব টেকনিশিয়ানদের ম্যানেজ করে সনদ বাণিজ্য করেছে।
ফলে সরকার হারিয়েছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সম্প্রতি রামেক হাসপাতাল করোনা পরীক্ষা ল্যাব থেকে উধাও হয়ে যায় প্রায় আড়াই হাজার করোনা পরীক্ষা কিট। এর সঙ্গেও এমন জালিয়াত চক্রের যোগসূত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আব্দুল কাইউম তালুকদার বলেন, এটা নিশ্চিতভাবেই একটি জালিয়াতি ও গুরুতর প্রতারণার কাজ। বিদেশগামী যাত্রী যে জেলারই হোক, রাজশাহী সিভিল সার্জনের নির্ধারিত বুথে নমুনা দিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। নমুনা সংগ্রহে নিয়োজিত চুক্তিবদ্ধ কোনো এনজিও বিদেশগামীদের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠাতে পারে না। এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। অভিযোগের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকায় বসবাসকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা সেতারা বেগম ১৪ সেপ্টেম্বর নমুনা দেন জাতীয় তরুণ সংঘকে। বয়স ৬২ বছর। ১৫ সেপ্টেম্বর রামেক হাসপাতাল ল্যাবে পরীক্ষায় তার করোনা পজিটিভ আসে। তার ঠিকানা দেওয়া হয় রাজশাহী মহানগরীর ওয়ার্ড নং-৪। তার ল্যাব সিরিয়াল নম্বর আরএমসিএইচ-১৫০৯২১৪৭।
মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ১৬ সেপ্টেম্বর দেওয়া নমুনায় সেতারা বেগমের করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। তবে এবার তার ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ওয়ার্ড নং-৫। এবার সেতারা বেগমের বয়স লেখা হয় ৫৪ বছর। মোবাইল নম্বরও দেওয়া হয় ভিন্ন।
সেতারা বেগমের নমুনা পরীক্ষায় দেওয়া দুটি মোবাইল নম্বরের একটিও তার নয়। প্রথমটিতে যোগাযোগ করা হলে মামুন নামে এক ব্যক্তি জানান সেতারা বেগম তার খালা। ঢাকায় থাকেন। অভিযোগ রয়েছে দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ল্যাব থেকে তাকে নেগেটিভ দেখিয়ে অনলাইনে নাম তুলে দেওয়া হয়েছে।
১৭ সেপ্টেম্বর নজরুল ইসলামের করোনার নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসে। তিনিও তরুণ সংঘের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষা করান। তাকে আরসিসির ১২নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা হয়। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে নজরুল ইসলামের দ্বিতীয়বার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ আসে। এবার নজরুল ইসলামকে আরসিসির ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেও নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই ল্যাব থেকে একদিন পর নেগেটিভ ফল অনলাইনে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
জানা যায়, করোনাকালে বাড়ি বাড়ি নমুনা সংগ্রহের জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন ২০২১ সালের ১৬ জুন জাতীয় তরুণ সংঘসহ দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়। তরুণ সংঘের ৭ জন স্বেচ্ছাসেবীকে সিটি করপোরেশন নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাতা প্রদান করছে।
বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করে রামেক হাসপাতাল ল্যাবে দেওয়ার জন্য তরুণ সংঘ শুধু কিটের মূল্য বাবদ রোগীর কাছ থেকে ৩০০ টাকা করে নেবে বলে রাসিকের আদেশ ও চুক্তিপত্রে বলা হয়। অথচ তরুণ সংঘ এই নির্দেশনা মানেনি। তারা কৌশলে বিদেশগামীদের কাছ থেকে ২ থেকে ৩ হাজার বা এর বেশি টাকা নিয়েছে।
ল্যাব টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে যোগসাজশ করে নমুনা না পাঠিয়েই শুধু টাকার বিনিময়ে অনলাইনে নাম তুলে দেওয়া হয়েছে অনেকের। আবার রাজশাহী নগরীর নির্ধারিত এলাকার বাইরের লোকদের, এমনকি বাইরের জেলার বাসিন্দাদের নমুনাও পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে কৌশল করে বাইরের জেলার ব্যক্তিদের ঠিকানা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকা।
ভারতগামী যাত্রী চুয়াডাঙ্গার দর্শনার মমতাজ বেগমকে নগরীর ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেখিয়ে নমুনা পাঠানো হয় ১৫ নভেম্বর। ১৭ নভেম্বর ভারতগামী যাত্রী লুৎফর রহমান লুটোকে নগরীর ৮নং ওয়ার্ডের হাজরাপুকুর এলাকার বাসিন্দা উল্লেখ করে ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়। তবে নগরীর হাজরাপুকুর এলাকাটি রাসিকের ৮নং ওয়ার্ডভুক্ত নয়।
এলাকাটি ১৯নং ওয়ার্ডভুক্ত বলে নিশ্চিত করেছেন কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম সুমন। এছাড়া ২১ নভেম্বর ভারতগামী ১৬ জনের নমুনা ল্যাবে পাঠায় তরুণ সংঘ। তাদেরকে নগরীর ২, ৬ ও ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও তাদের কারোরই বাড়ি রাজশাহী মহানগরীতে নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, ভিসা হওয়ার পর সিভিল সার্জনের বুথে নমুনা দিয়ে নেগেটিভ সনদ পেতে বিলম্ব হয়। অনেক সময় নমুনা বাতিল হয়ে যায়। তারা এই ঝামেলায় না গিয়ে জাতীয় তরুণ সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ করে। টাকার বিনিময়ে তাদেরকে নেগেটিভ সনদ প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। ফলে কিছু টাকা বেশি লাগলেও নিশ্চিতভাবে নেগেটিভ সনদ পেতেই তারা ঠিকানা বদল করে করোনা পরীক্ষা করিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী যুগান্তরকে জানান, এমন জালিয়াতির অভিযোগ তিনিও পেয়েছেন। হাসপাতাল ল্যাব থেকে আড়াই হাজার কিট গায়েবের বিষয়টি তদন্ত হচ্ছে। কিট গায়েবের সঙ্গে এই জালিয়াতির কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, কার নেগেটিভ বা পজিটিভ হচ্ছে, তা ল্যাব থেকেই অনলাইনে দিয়ে দেওয়া হয়। সিভিল সার্জন চাইলে তদন্ত করে দেখতে পারেন। এটা চেক করে দেখার সুযোগ তার নেই।
নির্ধারিত এলাকার বাইরের লোক ও বিদেশগামীদের নমুনা সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় তরুণ সংঘের সমন্বয়কারী ওয়াদুদ উল তাকাদ্দাছ কাজল বলেন, কার বাড়ি কোথায়, সেটা দেখার সুযোগ আমাদের নেই। অন্য জেলার লোক যদি বলেন, তার বাড়ি রাজশাহী নগরীতে, আমাদের কিছু করার নেই। আমরা নগরীর নির্ধারিত এলাকায় তাদের নমুনা নিয়ে ল্যাবে দিয়েছি। নমুনা পরীক্ষা ছাড়াই বিদেশগামীদের অনেককে প্রতারণার মাধ্যমে নেগেটিভ সনদ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। সূত্র : যুগান্তর
আরবিসি/০৫ জানুয়ারি/ রোজি