আরবিসি ডেস্ক: দশ টাকার ভাড়া পনের টাকা, দশ টাকার ভাড়া পনের টাকা। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরার পথে ছেড়ে যাওয়া প্রজাপতি পরিবহনের যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া কাটতে কাটতে থেমে থেমে হাঁক ছাড়ছিলেন চালকের সহকারী সেলিম মিয়া।
ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর পরিবহন ধর্মঘটে বাস বন্ধ ছিল গত তিন দিন। মালিকদের দাবিতে সরকার ভাড়া বাড়ানোর পর সোমবারই বাস চলাচল শুরু হয়েছে রাজধানীর রাস্তায়। তবে এখনও সমস্যা সেই ভাড়া। মিরপুর, আজিমপুর, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডাসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রে আগের তুলেনায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যদিও সরকার ভাড়া বাড়িয়েছে ২৭ শতাংশ।
বাসের হেলপার ও সহকারীদের ভাষ্য, সরকারের তরফ থেকে এখনও ভাড়ার নতুন তালিকা ছাপানো হয়নি। ফলে মালিক যেভাবে বলছেন, সেভাবেই তারা ভাড়া কাটছেন। স্বাভাবিকভাবেই যাত্রীদের অনেকে ওই বাড়তি ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে অনেক জায়গায় বাসকর্মীদের সঙ্গে তাদের বিতণ্ডা কিংবা হাতাহাতিও ঘটছে। প্রজাপতি পরিবহনের চালকের সহকারী সেলিম বললেন, ‘শতকরা ৮০ জনের সাথে ‘ ভাড়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। চিৎকার চেচামিচি হচ্ছে। গালাগালও দিচ্ছে।
হাসান নামের এক যাত্রী ওই বাসে করেই মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কলেজগেইট যাচ্ছিলেন। তার কাছে ১৫ টাকা নেওয়া হলে প্রতিবাদ করে ভাড়ার তালিকা দেখতে চাইলেন। কিন্তু সেলিম মিয়া তা দেখাতে না পারায় শুরু হল কথা কাটাকাটি। বচসা চলতে চলতেই কলেজ গেইট এসে গেল। টাকা ফেরত না পেয়ে হাসানও নেমে গেলেন।
সেলিম মিয়ার কাছে ভাড়ার তালিকা এবং মোহাম্মদপুর থেকে কলেজগেইটের দূরত্ব জানতে চাইলে তিনি বলেলেন, “মালিক সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা নিতে বলেছে। সব বাসে এই টাকাই নিচ্ছে।” রোববার বিকালে বিআরটিএ এর সাথে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর জানানো হয়েছিল, মহানগর এলাকায় প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সার থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হচ্ছে। আর মিনিবাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ টাকা ৫ পয়সা।
বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা এবং মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয় ওই বৈঠকে। পরে সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপনও জারি হয়। কিন্তু অনেক বাসেই তা মানতে দেখা গেল না। মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনের সামনে ইতিহাস পরিবহনের একজন কর্মী বললেন, মিরপুর থেকে সাভারের ভাড়া আগে নেওয়া হত ৩০ টাকা। তার মালিক এখন ৪৫ টাকা করে নিতে বলেছেন। যারা ওই ভাড়ায় রাজি হচ্ছেন, কেবল তাদেরই বাসে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ, এখানেও আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে গাবতলী যেতে ক্যান্টনমেন্ট পরিবহন আগে ১০ টাকা করে নিলেও এদিন যাত্রীদের কাছে ২০ টাকা করে আদায় করতে দেখা গেছে। অর্থাৎ, আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া তারা আদায় করছে।
মোহনা পরিবহন সাভারের ফ্যান্টাসি কিংডম পর্যন্ত ৫৫ টাকা করে আদায় করা শুরু করেছে, যদিও এতোদিন নেওয়া হত ৪০ টাকা। মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত দূরত্বে আলিফ পরিবহন এখন ৬৫ টাকা করে নিচ্ছে। এ পরিবহনের কয়েকজন কর্মী জানালেন, এতদিন তারা ৫০ টাকা করে নিতেন। অবশ্য সেটাও ছিল নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি।
ওই এলাকায় দেখা গেল রাস্তার পাশে অনেক যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকলেও ভাড়া শোনার পর অনেকেই আর বাসে ওঠেননি। পরের বাসের ভাড়া কম হতে পারে, এই আশায় ছিলেন তারা। যে কোনো বাসে মিরপুর ১০ থেকে মিরপুর-১ নম্বর গোল চত্বরে যেতে চাইলে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। মিরপুর-১ নম্বরে ট্রান্সসিলভা পরিবহনের এক বাসের হেলপার জানালেন, শাহবাগ পর্যন্ত দূরত্বে যেতে এখন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৬ টাকা, যা আগে ২০ টাকা ছিল। এইক্ষেত্রে ভাড়া বেড়েছে ৩০ শতাংশ।
বসুমতি পরিবহনে মিরপুর-১ নম্বর থেকে গাবতলী যেতে ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হচ্ছে যা আগে ৫ টাকা থেকে ৭ টাকার মধ্যে ছিল। ইতিহাস পরিবহনের সহকারী মোহাম্মদ দেলোয়ার বলেন, “সরকার ভাড়া নির্ধারণের পর এখনও ভাড়ার তালিকা তৈরি করা হয়নি। মালিক বলেছে, আগে যেখানে ১৬ টাকা নিতাম, সেখানে ২০ টাকা নিতে। ২৪ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা নিতে বলেছে। “যাত্রীর সঙ্গে ঝামেলা করে ওই ভাড়া আদায় করলেও আমাদের তো কোনো লাভ নাই। লাভ মালিকের। আমাদেরকে বেশি লাভ করতে হলে ধান্দা করে করতে হয়।”
সাভার থেকে বৈশাখী পরিবহনে মহাখালীতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, “আগে লাগত ৪০ টাকা। আজকে ৫৫ টাকা নিল। কী করব, উপায় তো নাই।” বাড্ডা, রামপুরা, মৌচাক এলাকার বাসে ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টর-যাত্রীদের মধ্যে হাতাহাতির মত ঘটনাও ঘটেছে। কোনো বাসেই নতুন ভাড়ার কোনো তালিকা দেখা যায়নি।
আকাশ, ভিক্টর ক্লাসিক, রাইদা, অনাবিল, তুরাগ, রমজান, তরঙ্গ, স্বাধীন, নূরে মক্কাসহ আরও বেশ কিছু পরিবহন এই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে। এর মধ্যে কেবল তুরাগ ছাড়া সব বাসই আগে বিআরটিএ এর নিয়ম না মেনে নিজেদের মত ভাড়া আদায় করত। স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসের কন্ডাক্টর মো. আরাফাত বললেন, “মালিকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত রাতেই ভাড়া নির্ধারণ করা হইছে। সেই অনুযায়ী আমরা ভাড়া চাইতেছি। কিন্তু যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিতে চায় না। চাইলে বকাবাজি করে।”
ভাড়া নিয়ে তর্কের মধ্যে আকাশ পরিবহনের এক বাসে কন্ডাক্টরের সঙ্গে এক যাত্রীকে হাতাহাতিতে জড়াতেও দেখা গেল। ওই বাসেই বাড্ডা থেকে গুলিস্তানে যাচ্ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মনির হোসেন। তিনি বললেন, বাড্ডা থেকে গুলিস্তান ভাড়া হওয়ার কথা ছিল ১০ থেকে ১২ টাকা, কিন্তু আগেই ২০ টাকা নেওয়া হত। এখন তার সাথে আরও পাঁচ টাকা যোগ হয়েছে।
“সরকারের তালিকা কোনো বাসই আগে মানত না, এখনও মানবে বলে মনে হয় না। আমার কথা হল- যদি নতুন করে নির্ধারিত ভাড়াও আদায় করা হয় তাহলে বাড্ডা-গুলিস্তানের ভাড়া ১৫ টাকার মধ্যেই থাকার কথা।” মায়ের সঙ্গে প্রতিদিন মিরপুর ১ নম্বর থেকে বাসে চেপে আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে আসতে হয় অষ্টম শ্রেণির ফেরদৌসীকে। আগে ১৫ টাকা করে ভাড়া দিলেও সোমবার দিতে হয়েছে ২০ টাকা। ফেরদৌসীর মা বললেন, “চাপতো সব যাত্রীর উপর। ভাড়া বাড়ালে আমাদের যে নাভিশ্বাস, তা কেউ খেয়াল করেছেন না।”
আরবিসি/০৮ নভেম্বর/ রোজি