আরবিসি ডেস্ক : নাচ শেখানোর আড়ালে তাদের একসময় ফাঁদে ফেলে পাচার করা হতো ভারতে। কামরুল ইসলাম জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল সিনেমাতে পাশ্ববর্তী নৃত্যশিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করতেন। পাশাপাশি ঢাকায় ড্যান্সক্লাব প্রতিষ্ঠা করে টার্গেট করতেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুন্দরী তরুণীদের। শুধুমাত্র এই চক্রের মাধ্যমেই গত ২-৩ বছরে শতাধিক তরুণী পাচার হয়েছেন।
এদিকে, আরেকটি নারী পাচার চক্র বিভিন্ন কাজে মধ্যপ্রাচ্যে নেওয়ার কথা বলে পাচার করতো। চক্রটি গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩৫ জন নারীকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পাচার করেছে।
এছাড়া, বৈধভাবে আরও প্রায় ২৫০ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে গেলেও কথা অনুযায়ী তাদের কাজ দেওয়া হয়নি, উল্টো তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা ও তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২২ জন নারী ও চুয়াডাঙ্গার জীবনগর এলাকা থেকে পাচার হওয়ার আগমূহুর্তে একজন নারীসহ সর্বমোট ২৩ জনকে উদ্ধার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এ সময় মানবপাচারকারী দুটি চক্রের ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ভারতে পাচার চক্রের মূলহোতা কামরুল ইসলাম ওরফে জলিল ওরফে ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুল (৩৭) ও তার চক্রের সদস্য রিপন মোল্লা (২২), আসাদুজ্জামান সেলিম (৪০), গাজীপুর থেকে নাইমুর রহমান ওরফে শামীম (২৫) এবং বনানী, পল্লবী, তেজগাঁও ও উত্তরা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার চক্রের মূলহোতা মো. নুর-নবী ভুইয়া রানা (৪৪) ও তার চক্রের সদস্য আবুল বাশার (৫২), আল ইমরান (৪১), মনিরুজ্জামান (৩৫), শহিদ সিকদার (৫৪), প্রমোদ চন্দ্র দাস (৬২) ও টোকনকে (৪৫) গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় অভিযানে ৫৩টি পাসপোর্ট, ২০টি মোবাইল ফোন, ৮ বোতল বিদেশি মদ, ২৩ ক্যান বিয়ার, দুটি মোটরসাইকেল, একটি ল্যাপটপ, একটি কম্পিউটার, ৯১ হাজার ৪০ টাকাসহ মানবপাচার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করা হয়।
শনিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে র্যাব- ৪ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, পাশ্ববর্তী দেশে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতা ডিজে কামরুল ওরফে ড্যান্স কামরুলসহ এই চক্রের সদস্য প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন।
২০১৯ সাল থেকে চক্রটি সক্রিয়ভাবে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। কামরুলের ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে প্রথমে চক্রটি নাচ শেখানোর নামে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুন্দরী তরুণীদের ঢাকায় নিয়ে আসা হতো।
এক সময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করিয়ে তাদের বেপোয়ারা জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করা হতো। পরবর্তীতে তাদের পাশ্ববর্তী দেশে আরও উন্নত জীবন-যাপনের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে দেওয়া হতো।
র্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কখনো বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার নামে তরুণীদের গ্রুপ নিয়ে ভারতে যেতেন কামরুল। সেখানে নিয়ে তরুণীদের ছকে ফেলে পাচার ও বিক্রি করে দেওয়া হতো। এভাবে চক্রটি গত ২-৩ বছরে প্রায় শতাধিক মেয়েকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে। সেখানে মূলত অমানবিক এবং অনৈতিক কাজ করানোর উদ্দেশে তাদের পাচার করা হতো।
এছাড়া, ভিকটিমদের প্রথমে সীমান্ত এলাকার সেফ হাউসে রাখা হতো। সীমান্তের ওপারে সিন্ডিকেটের যোগসাজসে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে পাচার করা হয় অনেককে।
এদিকে, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক চক্রটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার করতো উল্লেখ করে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এ চক্রে দেশে ১০-১২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। ৫-৭ বছর ধরে হাউস কিপিং, নার্স, রেস্টুরেন্ট পেশায় নারী কর্মীদের বিনা অর্থে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি বয়সী তরুণী ও মধ্য বয়স্ক নারীদের প্রলুব্ধ করতো এই চক্রটি। মূলত বিদেশে পাচারের মাধ্যমে ভিকটিমদের বিক্রি করে দেওয়া হতো।
এ পর্যন্ত চক্রটি ইতোমধ্যে ৩০-৩৫ জন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে। এছাড়া, বৈধভাবে অন্তত আরও ২০০-২৫০ জন নারীকে বিদেশে নিয়ে গেলেও তাদের নির্ধারিত কাজ না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কখনো তাদের সেসব দেশে আটকে রেখে স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হতো।
মধ্যপ্রাচ্যে নারী পাচারকারী চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার নুর-নবী ভুইয়া রানার নেতৃত্বে ঢাকায় কয়েকটি সেইফ হাউস পরিচালনা করা হতো জানিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বেশকয়েকদিন সেসব সেইফ হাউসে ভিকটিমদের আটকে রেখে পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয়।
প্রথমত তারা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উঠতি বয়সী এবং আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়স্ক নারীদের টার্গেট করে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে।
তাদের বিদেশে বিভিন্ন লোভনীয় চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়, এতে তারা রাজি হলে প্রথমে ঢাকায় সেফ হাউসে রেখে ভুয়া প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো। এ সময় কোনো নারী বিদেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে পাসপোর্ট ফেরত চাইলে তাদের কাছ থেকে দেড়-দুই লাখ টাকা আদায় করা হতো।
নুর-নবী ভুইয়া রানা ১৯৯৮ সাল থেকে দুবাই এবং ওমানে প্রবাসী হিসেবে কাজ করেন। ওমানে থাকা অবস্থায় মানবপাচারকারী একটি চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তখন থেকেই মানবপাচার কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন। ২০২০ সালে ওমান থেকে দেশে ফিরে মানবপাচারের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন তিনি।
আরবিসি/৩০ অক্টোবর/ রোজি