আরবিসি ডেস্ক : আজ শহীদ শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন। প্রথমবারের মতো এ বছর থেকে শেখ রাসেলের জন্মদিন জাতীয়ভাবে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ বছর থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিন ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে পালিত হবে। শেখ রাসেল দিবস ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত হিসেবে পালনের বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস।’ শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রবিবার পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর দুরন্তপ্রাণ এই শিশু তাঁর পিতার রাজনৈতিক জীবনকে দেখতে শুরু করেছিল মাত্র। বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেবার যখনই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, ঠিক তখনই নরঘাতকদের দল তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যেন শেখ রাসেল স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে, এটাই হয়ত ছিল তাঁর একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ।
এগারো বছরের শিশু রাসেল প্রতিদিনের মতো সেদিনও ঘুমিয়ে ছিল। আকস্মিক গুলির বীভৎসতায় তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে সে আতঙ্কিত হয়, চমকে ওঠে। অবস্থা বুঝে বেগম মুজিব আদরের দুলালকে রাসেলকে রক্ষায় কাজের লোকসহ পেছনের দরজা দিয়ে চয়ে যেতে বলেন। গেট দিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় ঘাতকরা তাকে আটক করে। এ সময় বাড়ির ভেতরে মুহুর্মুহু বুলেটের শব্দ আর বীভৎস আর্তচিৎকার শুনে অবুঝ শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঘাতকদের বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’
কিন্তু এতটুকু মন গলেনি পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃণ্য নরপিশাচদের। আগেই বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকল সদস্যদের পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছে। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঠা-া মাথায় একটি সুন্দর ও অবুঝ শিশু শেখ রাসেলকেও গুলি করে হত্যা করে নিষ্ঠুর ও ইতিহাসের ঘৃণ্য পাপিষ্ঠরা।
সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের উত্তেজনায় মুখর। ১৯৬৪ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই সময় সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী কায়দে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। যিনি এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাঙালী জাতিকে এনে দেবেন মুক্তির স্বাদ, তাঁরই (বঙ্গবন্ধু) ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানম-ির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে এলো শেখ রাসেল। শেখ রাসেলের যেদিন জন্ম হয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
সে দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন- ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেজ ফুফু মার সঙ্গে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেজ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।’
রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তাঁর মহৎ কোন স্বপ্ন বা আকাক্সক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, বাঙালীর জাতির জনক, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে, কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকা- কোথাও ঘটেনি। হত্যাকা-ের সময় আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল শেখ রাসেলকে।
রাসেল নামের এই শান্তিপ্রিয় মানবিক ফুলটিকে আর ফুটতে দেয়া হলো না। শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তাঁর সব অবিকশিত সম্ভাবনাও। বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেবার যখনই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, ঠিক তখনই নরঘাতকদের দল তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আরবিসি/১৮ অক্টোবর/ রোজি