• শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২১ পূর্বাহ্ন

সত্তর বছর পর বাগমারা থেকে নবীনগর

Reporter Name / ১৮০ Time View
Update : শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার : ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলে অবশেষে মায়ের কোলে ফিরেছেন রক্তের টানে। দীর্ঘ ৭০ বছর পর রাজশাহীর বাগমারা থেকে মায়ের সন্ধানে ব্রাম্মনবাড়িয়ার নবীনগরে ছুটে গেলেন আবদুল কুদ্দুস মুন্সি। এখন তার বয়স ৮০ বছর। আর তার মা মঙ্গলেমা বিবির বয়স একশোর উপরে। ৭০ বছর আগে হারিয়ে যায় শিশু আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। তখন তার বয়স ছিলো ১০ বছর।
শনিবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বাড্ডা গ্রামে পৈত্রিক বাড়িতে ফিরেন আব্দুল কুদ্দুস। আগে থেকেই বাড়ির সামনে একটি চেয়ারে বসে ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন শতবর্ষী মা। সেখানে ঘটে এক হৃদয় বিদারক মূহুর্ত। ৭০ বছর পর দেখা হওয়ায় পর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মা ও ছেলে। সঙ্গে প্রতিবেশী ও স্বজনরাও আপ্লুত হয়ে পড়েন। এ যেন অন্য আনন্দের ধারা।

বৃদ্ধ মা-ছেলের আবেগ ঘন মূহুর্তে ছোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি আশপাশের লোকজনও। ৭০ বছর পর ছেলে তার মায়ের কাছে ফিরছেন এমন খবরে আগে থেকে গ্রামের লোকজনসহ সংবাদ কর্মীরা ভিড় করেন মঙ্গলেমার বিবির বাড়িতে।

কুদ্দুস মন্সির চাচাতো ভাইয়ের নাতি শফিকুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার আত্রাই স্টেশন থেকে রাতে ট্রেনে ব্রাহ্মবাড়িয়ার উদেশ্যে রওনা হন আব্দুল কুদ্দুস মন্সি। সকালে তিনি ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশনে নামেন। সেখান থেকে আমি তাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাড্ডা গ্রামে নিয়ে যায়। এর মধ্যেমে ৭০ বছর পর মা ফিরে পান তার ছেলেকে; আর ছেলে মাকে।

হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর পর আপন ঠিকানাসহ প্রিয়জনদের সন্ধান পেয়ে এখন খুশি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারুইপাড়া গ্রামে বসবাস করা আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে সন্ধান পাওয়ার পর ছেলেকে দেখার আশায় পথ চেয়ে ছিলেন আব্দুল কুদ্দুসের শতবর্ষী মা মঙ্গলেমা বিবি।

আব্দুল কুদ্দুস ও তার পরিবার সূত্রমতে, ৭০ বছর আগে পুলিশ (দারগা) সদস্য চাচার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে রাজশাহীর বাগমারায় বেড়াতে এসে হারিয়ে যান ১০ বছর বয়সী আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। অনেক খোঁজা-খুজির পর তাকে না পাওয়া গেলে, পরিবারের সদস্যরা মনে করেন সম্পত্তির লোভে পিতা-মাতার একমাত্র পুত্র সন্তান আব্দুল কুদ্দুসকে বেড়াতে নিয়ে যাবার নাম করে হত্যা করে তার চাচা।
তবে সেই আশঙ্কা মিথ্যে প্রমান হল ৭০ বছর পর। ৭০ বছর পর হারিয়ে যাওয়া সেই আব্দুল কুদ্দুস মুন্সিকে খুঁজে পেয়েছে তার পরিবার। তবে ১০ বছরের সেই ছোট্ট শিশুটি আজ ৮০ বছরের বৃদ্ধ। তারও পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা বেড়েছে কালক্রমে।

কুদ্দুস মন্সির চাচাতো ভাইয়ের নাতি শফিকুল ইসলাম জানান, গত ১২ এপ্রিল কুদ্দুস মুন্সির পাশের গ্রামের আইয়ূব আলী নামের পরিচিত একজনের ফেসবুক আইডিতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলেন আব্দুল কুদ্দুস। সেখানে তিনি শুধু পিতা-মাতা ও নিজ গ্রাম বাড্ডার নাম বলতে পারেন।

পরে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড্ডা গ্রামের বাসিন্দারা সাড়া দিতে থাকেন। একপর্যায়ে ভিডিওটি আমার নজরে আসলে আইয়ুব আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আব্দুল কুদ্দুসকে খুঁজে পাই। এরপর আব্দুল কুদ্দুস মুন্সির ভাগ্নেসহ চারজন গত ২১ সেপ্টেম্বর তার বাসায় আসেন।

শফিকুল ইসলাম আরও জানান, কুদ্দুস মুন্সির পিতা কালু মুন্সির তিন সন্তান ছিলেন। এখনও জীবিত আছেন তার শতবর্ষী মা মঙ্গলেমা বিবি (১১০) ও এক বোন। গত ২১ সেপ্টেম্বর মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেছেন আব্দুল কুদ্দুস। আর এত বছর পর নিজের পরিবার খুজে পাওয়ায় খুশি আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী-সন্তানরাও।

তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরাসহ গ্রামবাসীর মধ্যে প্রচার ছিল জমি আত্মসাত করার জন্য ছোট চাচা পুলিশের দারগা বেড়াতে নিয়ে গিয়ে তাকে মেরে ফেলেছেন। এ ঘটনার পর তার চাচা আর কোনদিন গ্রামের বাড়ি যাননি।
আইয়ুব আলী বলেন, বারুইপাড়া বাজারের মোড়ে এক চায়ের দোকানে বসে ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলছিলেন আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি। তার গল্পটি ফোনে রেকর্ড করে গত ১২ এপ্রিল আমার ফেসবুক পেজে আপলোড করি। আর ফেসবুকে ওই পোস্টের উপরে লিখে ছিলাম যে, ব্রহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার এই বৃদ্ধা আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হারিয়ে গিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। কেউ যদি তার কথা শুনে চিনতে পারেন।

তিনি আরো বলেন, তার পরে বহু মানুষ সেই পোস্ট শেয়ার করেন। বিদেশের কিছু মানুষ ওই এলাকার আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন তারা দেখেন। তার পরে ওই এলাকার মানুষ ফেসবুকে আব্দুল কুদ্দুসের ভিডিও শুনে ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুসের সন্ধান পান তার পরিবারের মানুষ।

আব্দুল কুদ্দুস জানান, আমার চাচা বাগমারা থানায় আমাকে বেড়াতে নিয়ে আসে। তিনদিন থানায় ছিলাম চাচার সঙ্গে। তবে সেখানে থাকতে ভাল লাগছিল না। এ জন্য থানা থেকে বের হয়ে হারিয়ে যায়। হাটতে হাটতে আত্রাইয়ের সিংসাড়া গ্রামে চলে যায়। ওই গ্রামের মৃত সাদেক আলীর বাড়িতে আশ্রায় পাই এবং সেখানেই বড় হই। পরে বাগমারা বারুইপাড়া গ্রামে বিয়ে করে সেখানেই সংসার করি। তার তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। দুই ছেলে থাকে বিদেশে। আর এক ছেলে বাড়িতে।

তিনি বলেন, আমার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে প্রথম যখন কথা বলি তখন আমার মা আমাকে বলে তুই আমার হারিয়ে যাওয়া আব্দুল কুদ্দুস বাবা। তোর ছোট বেলায় হাত কেটে গিয়েছিলো। মায়ের মুখে এ কথা শুনার পরে আমি বলি, মা তোর কুদ্দুসের কোন হাত কেটে গিয়েছিলো, তখন মা বলে বাম হাতের বুড়া আঙ্গুলের কেটে গিয়েছিলো, তখন আমি বুঝতে পারি যে তিনিই আমার মা।
এদিকে, হারিয়ে যাবার ৭০ বছর পর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি আলোড়ন ফেলেছে আব্দুল কুদ্দুসের বর্তমান আবাস বাগমারার বারুইপাড়া গ্রামে। চায়ের দোকান থেকে পাড়ামহল্লার মোড়ে মোড়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে আব্দুল কুদ্দুসের গল্প। রাজশাহী নগরেও এ গল্প এখন চাউর হচ্ছে। মা ও ছেলের ৭০ বছর পর দেখা হওয়ার দৃশ্যও এখন সমানে ভাইরাল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অনেক বলছেন, এটিও হলো রক্তের বাঁধন। যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।

আরবিসি/২৫ সেপ্টেম্বর/ রোজি

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category