আরবিসি ডেস্ক : শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ আর থাকছে না। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না। দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি শেষ করে একটি পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুই বছর পাঠদান শেষে পাবলিক পরীক্ষার বদলে প্রতি বছর মূল্যায়ন করা হবে। ওই মূল্যায়নের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে ফল। এভাবেই কমে যাবে পরীক্ষা। একই সঙ্গে কমবে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যাও।
বিজ্ঞান বিভাগে পড়া নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতাও থাকছে না। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ নির্ধারণ করবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকবে গুচ্ছ ভিত্তিক বিষয় নির্ধারণ। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে পরীক্ষামূলক নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে।
গতকাল সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন কারিকুলামের ফ্রেম ওয়ার্ক অনুমোদনের পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এসব তথ্য জানান।
২০২৩ সাল থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম : ২০২৩ সাল থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে সরকার। নতুন এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বার্ষিক পরীক্ষা থাকবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সেই সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল মিলে হবে এইচএসসির ফল।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যক্রমের ওপর। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারিত হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল মিলিয়ে।
নবম দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ইত্যাদি বিভাগ থাকবে না। একজন শিক্ষার্থী কোন বিভাগ নিয়ে পড়বেন, সেটা ঠিক করবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে। শিক্ষা নিয়ে সরকারের নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য সামনের বছর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ছয় মাস প্রয়োগ করা হবে। সেটার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও থাকবে না বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। এছাড়া শুধু ১০ম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে হবে পাবলিক পরীক্ষা।
কারিকুলাম বাস্তবায়নের রোড ম্যাপ : নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছর প্রাথমিকের ১০০ ও মাধ্যমিক স্তরের ১০০টি স্কুলে পাইলটিং করা হবে। ২০২৩ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে চালু করা হবে। ২০২৪ সালে প্রাথমিকে তৃতীয় ও চতুর্থ এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে, পরের বছর প্রাথমিকের পঞ্চম ও মাধ্যমিকে দশম শ্রেণিতে চালু করা হবে। ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম চালু করা হবে।
শ্রেণিভিত্তিক মূল্যায়ন হবে যেভাবে : প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শিখনকালীন ৬০ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান শিখনকালীন ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ এবং জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি,শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান শিখনকালীন ৫০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৫০০ শতাংশ এবং জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি,শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে।
দশম শ্রেণির পাঠ্য সূচির উপর পাবলিক পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন ৩০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৭০ শতাংশ। নৈর্বাচনিক/বিশেষায়িত বিষয়ের কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। এ স্তরে প্রায়োগিক বিষয়ে শিখনকালীন শতভাগ মূল্যায়ন। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির উপর প্রতিবর্ষ শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হবে।
হতে পারে এইচএসসির নাম ও গ্রেডিং পদ্ধতির পরিবর্তন : নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এইচএসসি পরীক্ষার নাম ও গ্রেডিং পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গতকাল সোমবার জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপনের পর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
দীপু মনি বলেন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল মিলে হবে এইচএসসির ফল। এইচএসসি পরীক্ষার নাম ও গ্রেডিং পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে।
তিনি বলেন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ বিভাজন থাকবে না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষাও হবে না। পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাও থাকবে না বলে জানান মন্ত্রী। এছাড়া শুধু ১০ শ্রেণির পাঠ্যক্রমে হবে পাবলিক পরীক্ষা। শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল মিলে হবে এইচএসসির ফল।
উল্লেখ্য, শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিতে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় ২০১৬ সালে। কমিটির সদস্যদের নিয়ে ওই বছরের ২৫ ও ২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুই দিনের আবাসিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষাবিদরা বেশকিছু সুপারিশ করেন।
সুপারিশ বাস্তবায়নে কয়েকটি সাব-কমিটিও গঠন করা হয়। শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা সাব-কমিটি ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আট দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষাক্রমের বিষয়বস্তু গুরুত্ব অনুসারে তিন গুচ্ছে ভাগ করার পরামর্শ দেন তারা।
‘ক’ গুচ্ছে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত। ‘খ’ গুচ্ছে বিজ্ঞান, সমাজ পাঠ (ইতিহাস পৌরনীতি ও ভূগোল)। ‘ক’ ও ‘খ’ গুচ্ছ বাধ্যতামূলক। আর ‘গ’ গুচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি, চারু-কারুকলা, শরীরচর্চা ও খেলা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি ও গার্হস্থ্য, নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। এছাড়া ‘গ’ গুচ্ছে প্রকৌশল প্রযুক্তি (বিদ্যুৎ, যন্ত্র, কাঠ, ধাতু ইত্যাদির ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রয়োগ) যুক্ত করার মত দেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষাবিদদের মতে, ‘গ’ গুচ্ছের বিষয়ে জ্ঞান ও তত্ত্বের চেয়ে চর্চা, আগ্রহ বৃদ্ধি, মনোভাবের পরিবর্তন ও সৃজনশীলতার প্রকাশ এবং প্রায়োগিক দক্ষতা বেশি প্রয়োজন। এসব বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও এর সঙ্গে যুক্ত সুচিন্তিত সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলীর নিবিড় যোগ স্থাপন করার মত দেন শিক্ষাবিদরা। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ধারণা দিতে নির্দেশিকা তৈরি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেন।
সূত্র জানায়, ১৮ জেলার ৮৬ জন শিক্ষকের মতামত, ১১টি সভা, ছয়টি কনফারেন্স, দুটি স্কুলের ১০০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন (এফডিজি), ২১ জন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞের মতামতের আলোকে শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা কমিটি সুপারিশ দিয়েছে। এ সুপারিশের ভিত্তিতে নতুন কারিকুলাম তৈরি করছে এনসিটিবি।
এদিকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের দাবি, বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালু করলে বিজ্ঞান বিষয়ের গুণগত মান কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকলে উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সিলেবাসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না। কারণ বর্তমানে নবম-দশম শ্রেণির বিজ্ঞানের বিষয়ের বইগুলোয় যেসব কনটেন্ট আছে, তা মানসম্মত নয়। তবে নতুন পদ্ধতি চালু করলে বিজ্ঞান বইয়ের মান যাতে কমে না যায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে তারা।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সংগতি রেখেই নতুন কারিকুলাম চূড়ান্ত করা হবে।
শিক্ষাবিদরা জানান, অনেক শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে এক বিভাগ থেকে পাস করে উচ্চশিক্ষা নেয় অন্য বিষয়ে। শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পাস করে উচ্চ মাধ্যমিকে অন্য বিভাগে ভর্তি হয়। তারা বিভাগ নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। গুচ্ছভিত্তিক পদ্ধতি চালু করা হলে এ সমস্যা থাকবে না। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সব শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাস বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারবে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করে ভর্তি হবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ পদ্ধতি চালু আছে বলেও তারা জানান।
আরবিসি /১৪ সেপ্টেম্বর/ রোজি