আরবিসি ডেস্ক: ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, যমুনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উত্তরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়া অব্যাহত রয়েছে। তিস্তা নদীর তীরবর্তী নীলফামারীর অন্তত দশটি ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি চরগ্রাম প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটের প্লাবিত এলাকার লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি চুইয়ে বের হওয়ায় বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামের উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুরে নিম্নাঞ্চলে বসতভিটায় পানি ওঠায় লোকজন বাঁধে অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটসহ পয়নিষ্কাষণের সমস্যা দেখা দিয়েছে। দেখা দেয় গবাদিপশুর খাদ্য সংকট।
উজানে ভারি বৃষ্টপাত আর পাহাড়ি ঢলে নীলফামারীতে বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে তিস্তা নদীর পানি। শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তার তীরবর্তী জেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় ২৫টি চরগ্রাম প্লাবিত হয়ে পাঁচ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সর্তকীকরণ কন্দ্রে জানায়, শুক্রবার সকাল ৬টায় বিপৎসীমার অতিক্রম করে ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর সকাল ৯টায় আরও ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
ডিমলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, হঠাৎ পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তিস্তা নদী বেষ্টিত পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের দুটি চরগ্রমারে এক হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। একই উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল ইসলাম বলেন, পানিতে তার ইউনিয়নের ছয়টি চরগ্রাম প্লাবিত হয়ে দুই হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি উঠায় খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে এসব পরিবারের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
একই উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, ভেন্ডাবাড়ি চরগ্রামস্থ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুই নম্বর স্পার বাঁধে দেড়শ মিটার ভেঙে ইতোমধ্যে ৬০ পরিবারের বসতভিটা নদীর গর্ভে বিলীন হয়েছে। ওই সব পরিবার বর্তমানে নদীর ডান তীর বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। “এখন কটিপাড়া আশ্রয়ন প্রকল্পটি ভাঙ্গনের হুমকির মুখে রয়েছে। বর্তমানে ওই আশ্রয়ন প্রকল্পের ৪০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে রয়েছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফা-উদ-দৌলা বলেন, উজানের ঢলে সকাল ৯টা থেকে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে দুপুরের পর থেকে নদীর পানি কমে সন্ধ্যা নাগাদ বিপৎসীমার নিচে নামবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
তিনি আরও বলেন “নদীর ২ নম্বর স্পার বাঁধের ভাঙ্গা স্থানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানো হয়েছে। তবে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁধটি হুমকিতে রয়েছে। আমারা সেটি পর্যবেক্ষণে রয়েছি। পাশাপাশি মেরামত কাজ অব্যাহত রেখেছি। নদীর পানি না কমা পর্যন্ত বাঁধটি স্থায়ীভাবে মেরামত করা যাচ্ছে না। পানি কমলে বাঁধটি স্থায়ী ভাবে মেরামত করা হবে।”
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে বগুড়ার সারিয়াকান্দ, ধুনটের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। শুক্রবার দুপুরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পানি চুইয়ে যাওয়ায় বাঁধ ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশের পাইলিং এবং বালির বস্তা ফেলে জরুরি বাঁধ রক্ষায় প্রতিরক্ষামূলক কাজ করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাযকিয়া জানান, কামালপুরের রৌহাদহ গ্রোয়েন বাঁধের বেশির ভাগ অংশ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থান দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ায় বাঁশের পাইলিং এবং বালির বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষায় জরুরি প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশল মাহবুবুর রহমান বলেন, বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যমুনার পানি প্রবাহিত হলে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়। সেই ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও নিয়ন্ত্রণে আছে সবকিছু।
সারিয়াকান্দি উপজেলা কৃষি অফিসার আব্দুল হালিম জানান, বন্যায় রোপা আমন ১৬৫ হেক্টর, বীজতলা ১২ হেক্টর, সবজি ১৭ হেক্টর, মাসকালাই ২২ হেক্টরসহ ২১৬ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা শিক্ষা অফিসার গোলাম কবির জানান, উপজেলার ২৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ১টি মাদ্রাসায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে।
আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দিলেও এখন তা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করেন। সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর, কাজলা, চালুয়াবাড়ি, কর্ণিবাড়ী , বোহাইল, কুতুবপুর,চন্দনবাইশা ও কামালপুর সহ ৯টি ইউনিয়নের ৬৯টি গ্রামের ৫১হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে ।
সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক বন্যা দুর্গত এলাকায় জিআরের ৮০ মেট্রিক টন চালসহ অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত আছে। ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার মোহন্ত জানান, বন্যার্তদের ত্রাণের ব্যবস্থসহ বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েলের ব্যাবস্থা করা হচ্ছে। কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়েছে। ব্রহ্মপূত্র নদের পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় কুড়িগ্রামের উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও চর রাজিবপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকালে ব্রহ্মপূত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়াও ব্রহ্মপূত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল হাই সরকার জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত জেলার নয় উপজেলার মধ্যে পাঁচটির ১৩ ইউনিয়নে চার শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএম আবুল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে।
অপরদিকে উলিপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টু জানান, উলিপুরে আটটি ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার পরিবার পানিবিন্দ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক জানান, বন্যার ফলে জেলায় প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর রোপা আমন, শাকসবজি ও বীজতলা তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, বন্যা দুর্গতদের আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তর; তাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও ভ্রাম্যমাণ শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার থেকে উপ-বরাদ্দকৃত ২৮০ মেট্রিক টন চাল ও ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা দুর্গত এলাকায় বিতরণ শুরু হয়েছে।
আরবিসি/০৪ সেপ্টেম্বর/ রোজি