• বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০২ পূর্বাহ্ন

মিশু-পিয়াসাদের গাড়িবিলাস

Reporter Name / ১১৬ Time View
Update : মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০২১

আরবিসি ডেস্ক : মিশু হাসান-পিয়াসা ও রাজ সিন্ডিকেটের চোখধাঁধানো গাড়িবিলাস দেখে তাজ্জব বনে গেছেন গোয়েন্দারা। শুধু নিজের ব্যবহারের জন্যই নয়, তারা মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিদেশ থেকে এনে চড়া দামে বিক্রি করতেন বিলাসবহুল সব গাড়ি। ইতিমধ্যে তাদের ব্যবহার করা ছয়টি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। আরও কত গাড়ি এই চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তা খোঁজার চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই চক্র মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে শত শত গাড়ি এনে বিক্রি করেছে, যার মধ্যে বিশ্বখ্যাত বুগাত্তি, ফেরারি, মার্সিডিজ, অডি, অডি আর, পোরশে, ল্যাম্বারগিনি, মাজদা, বিএমডব্লিউ, লেক্সাস, রেঞ্জ-রোভারসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নানা মডেলের গাড়ি রয়েছে। সিআইডি এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এসব গাড়ির আমদানি ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

মিশু হাসান-পিয়াসা গংদের গাড়িবিলাস সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ঢাকা মেট্রো বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে ছয়টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করেছি। তাদের মিথ্যা ঘোষণায় এবং চোরাই পথে গাড়ি আনা ও বিক্রির কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে আমরা কোনো তথ্য প্রকাশ করতে চাই না।’ শুল্কা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালে শুল্কহীন কমপক্ষে ৭০টি অবৈধ গাড়ি খোঁজ মেলে। সেগুলোর তদন্তে আমদানি ও বিক্রয়কারী হিসেবে উঠে আসে শরিফুল ইসলাম মিশু ওরফে মিশু হাসানের নাম। ডিউটি-ফ্রি গাড়ি আমদানি ও বেশি সিসির গাড়িকে কম সিসি দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি এবং বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রির অভিনব কারবার শুরু করেন মিশু হাসান। মূলত কারনেটের মাধ্যমে গাড়ি আমদানি করে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মিশু হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। পুরনো মডেলের গাড়ির বডি পরিবর্তন করে এবং ইঞ্জিনে বিশেষ কৌশলে নম্বর খোদাই করে নতুন বলে বিক্রি করতেন তারা। এর মাধ্যমেও গ্রাহকের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা করে এই সিন্ডিকেট।
শুল্ক গোয়েন্দার অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে তিন-চার হাজার বা এরও বেশি সিসির গাড়ি আমদানিতে শুল্কের হার ৮২৬ শতাংশ। আর এসব গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশে শুল্ক ৭৪২ শতাংশ। মূলত উচ্চ হারের শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে মিশু হাসান ও তার সহযোগীরা মিথ্যা ঘোষণায় সিসি কম দেখিয়ে গাড়ি আমদানি করতেন। বিআরটিএ থেকেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা ঘুষ দিয়ে তারা নিবন্ধন নিতেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে জাল কাগজ তৈরি করে এবং ভুয়া নম্বর প্লেট দিয়ে এসব গাড়ি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হতো।
রাজধানীর গুলশান এলাকার একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা নিয়ম মেনে এলসির মাধ্যমে একটি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করলে সেটির দাম পড়ে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। একই মডেলের গাড়ি মিশু হাসানরা বিক্রি করতেন ২ কোটি টাকারও কমে। কারণ তারা মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এসব গাড়ি নিয়ে আসতেন। বিশেষ করে লন্ডন, দুবাই ও জাপান থেকে এসব গাড়ি আনা হয়। মিশু হাসানের রোডিও ড্রাইভ লিমিডেটের বিভিন্ন শোরুমে এবং অন্যান্য শোরুমে গাড়িগুলো রেখে বিক্রি করা হয়। এখনো বিভিন্ন শোরুমে শিশু হাসানের গাড়ি রয়েছে বলে দাবি করেন ওই ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘মিশু হাসান পুলিশ হেফাজতে থাকায় তার হয়ে এসব ব্যবসা দেখাশোনা করেন শামস নামে এক ব্যক্তি। এই শামসের বিরুদ্ধেও গাড়ির অবৈধ ব্যবসা ও নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। এ চক্রের প্রতারণামূলক ব্যবসার কারণে নিয়ম মেনে যারা ব্যবসা করেন তাদের ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে।’

র‌্যাব, ডিবি ও সিআইডির অভিযানে ছয়টি গাড়ি জব্দ করা হয়। এগুলোর মধ্যে লাল রঙের ঢাকা মেট্রো চ-১২-৯১৮০ নম্বরের গাড়িটির মালিক শরিফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান। ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার কাছ থেকে জব্দ হয় দুটি গাড়ি, যার একটি বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের, নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-৩৯-৮৫৭৪ ও অপরটি মাজদা ব্র্যান্ডের, নম্বর ঢাকা মেট্রো গ-৩৪-৫০০৯। নজরুল ইসলাম ওরফে নজরুল রাজের কাছ থেকে দুটি গাড়ি জব্দ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে হেরিয়ার ব্র্যান্ডের ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৬৪০১ ও ঢাকা মেট্রো গ-১৩-৪৬১৭। পরীমণির কাছ থেকে জব্দ করা হয় ঢাকা মেট্রো ঘ-১৫-৯৬৫৩ নম্বর গাড়ি।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, মিশু হাসানের ফেরারি ব্র্যান্ডের এফ-৪৩০ সিরিয়ালের ৬ হাজার সিসির গাড়ি জব্দ করা হয় গুলশান ১১১ নম্বর সড়কের অটো মিউজিয়াম থেকে। এই শোরুমটির মালিক বারভিডার সাবেক সভাপতি হাবীবুল্লাহ ডন। গাড়িটি বিক্রির জন্য ওই শোরুমে রাখা হয়েছিল। এ ধরনের উচ্চ সিসির গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি নিষিদ্ধ। এ কারণে সেগুলোর বৈধভাবে নিবন্ধনের সুযোগ নেই। অটো মিউজিয়াম থেকে উদ্ধার গাড়িটিতে যে নম্বর প্লেট লাগানো ছিল, সেটি ছিল জাল। মিশু হাসান ও তার সহযোগীরা কতসংখ্যক গাড়ি মিথ্যা ঘোষণায় এনে বিক্রি করেছেন সেই তথ্য জানার জন্য তদন্ত কর্মকর্তারা শরিফুল হাসান মিশুর মালিকানাধীন রোডিও ড্রাইভ লিমিডেটসহ কয়েকটি কোম্পানির গাড়ি আমদানি ও বিক্রির নথিপত্র তলব করেছেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, চোরাই গাড়ি বিক্রিতে মিশু হাসানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। তারা কৌশলে চোরাই পথে আনা ল্যাম্বারগিনিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গাড়ি বিক্রি করেন। এ জন্য গোপন চ্যাটিং গ্রুপ খুলে প্রথমে গাড়ির লোগো পোস্ট করেন। এরপর দেন গাড়ির দরজার ছবি। এরপর রংসহ গাড়ির বিভিন্ন অংশ। এভাবে গাড়ি সম্পর্কে ক্রেতার আকর্ষণ তৈরি করতে পুরো ছবি পাঠানো হয়। শুল্ক দিয়ে বৈধ পথে ল্যাম্বারগিনি আমদানি করতে হলে একেকটি গাড়ির দাম পড়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। কিন্তু এই চক্র পুরনো গাড়ি মিথ্যা ঘোষণায় এনে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে তুলনামূলক কম দামে বিক্রি করত। পিয়াসার মাধ্যমে মিশু হাসান নামিদামি ব্র্যান্ডের শতাধিক গাড়ি বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মার্সিডিজ, মার্সিডিজ-মেব্যাক, মার্সিডিজ-বেঞ্জ জি ক্লাস, অডি, অডি আর-৮, ল্যাম্বারগিনি, মাজদা, বিএমডব্লিউ, লেক্সাস-৫৭০ মডেলসহ বিভিন্ন মডেলের গাড়ি। কয়েকজন সংসদ সদস্যের ছেলেও তাদের কাছ থেকে বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। মার্সিডিজ-মেব্যাক মডেলের বিলাসবহুল একটি গাড়ির দাম ৮ কোটি টাকা হলেও পিয়াসা-মিশু সিন্ডিকেট ৪ কোটি টাকায় বিক্রি করত। বিদেশ থেকে একটি গাড়ি ১ কোটি টাকায় কিনলেও প্রতিটি গাড়িতে তারা শুল্ক ফাঁকি দিত কমপক্ষে ৭ কোটি টাকা। চোরাই পথে আনা গাড়ি বিক্রিতে এই সিন্ডিকেট নানা কৌশলের আশ্রয় নিত। ১০ বছর আগের মার্সিডিজ গাড়ি দেশে এনে নতুন দরজা লাগানো হয়। পরে সেই গাড়ির বনেটের নিচে খোদাই করে নতুন নম্বর বসিয়ে দেয় তারা। এরপর পুরনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর নতুন গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে ফাঁকি দিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ। পাশাপাশি বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি করত এই সিন্ডিকেট। আর পুরনো গাড়িটি নষ্ট করে ফেলত। এভাবেই পিয়াসা-মিশুরা একের পর গাড়ি বিক্রি করে রেজিস্ট্রেশন নম্বরও করে দিতেন, আদতে যা সম্পূর্ণ অবৈধ।

আরবিসি/১৭ আগস্ট/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category