আরবিসি ডেস্ক : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে আমরা ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামকে বুঝে থাকি। যান্ত্রিক এই যুগে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেই এগুলো ব্যবহার করে থাকে মানুষ। কিন্তু যোগাযোগ রক্ষার এই মাধ্যম এখন হয়ে উঠেছে এক ধরনের ঘাতক, যা ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। বলা যায়, বর্তমানে সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট করার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এসব মাধ্যমে নানা কর্ম আর অপকর্ম নষ্ট করছে সমাজ, সংস্কৃতি আর ভাঙছে ঘর-সংসার। দুর্বল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন, বাড়ছে মানুষে মানুষে সম্পর্কের দূরত্ব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল মাধ্যমে বেশি নির্ভরশীল হওয়ায় সরাসরি আলাপচারিতা, মতবিনিময় এবং যোগাযোগ কমে যাচ্ছে। এতে নানান নেতিবাচক চিন্তাধারণা সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে। অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের।
ফলে বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য ও সম্পর্ক। ভেঙে যাচ্ছে অনেকের সাজানো গোছানো সুখের সংসারও।
রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, এখানে গড়ে প্রতিদিন ৩৯টি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে এবং প্রতি ঘণ্টায় একটি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া পুরো দেশে বিগত ৭ বছরে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞ এবং ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের অন্যপাশে থাকা ব্যক্তি ভার্চুয়াল পর্দার আড়ালে থাকায় তার দেওয়া চমকপ্রদ তথ্য অনেক সময়েই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আর এমন ফাঁদের অন্যতম টার্গেট হচ্ছেন নারীরা। ফলে অনেকের সংসারেই লেগেছে ‘ডিজিটাল আগুন’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুরের এক গার্মেন্টস শ্রমিক জানান, টিকটকের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে মডেল হতে তার স্ত্রী পাড়ি জমান ভারতে। সেই ব্যক্তি বলেন, আমার স্ত্রীকে একটি স্মার্টফোন কিনে দিলে সে টিকটক দেখা শুরু করে। পরে টিকটকে নিজেই ভিডিও দিতো। এভাবে কার সঙ্গে যেন পরিচয় হয়। একদিন বাসায় এসে দেখি সে বাড়িতে নেই। ফেসবুকে আমাকে মেসেজ দিয়ে রেখেছে, টিকটকে পরিচয় হইছে একজনের সঙ্গে। তার সঙ্গে সে মডেল হতে ভারত যাচ্ছে। আমাদের একটা পোলা আছে। তাকে রেখেই চলে গেছে। আমার সংসার শেষ।
এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারকদের ফাঁদে পড়ছেন নারীরা।
এদিকে, গত ২৫ জুন আব্দুল আলিম (৩২) নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করে পুলিশ। নিজেকে পুলিশের ‘এএসপি’ পরিচয় দিয়ে বিয়ে করেন বগুড়ার এক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে। পরে জানা যায়- তিনি ছিলেন বাদাম বিক্রেতা। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েও নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন অনেকে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইদানিং আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। সরাসরি যোগাযোগে আমরা অনেককিছু ভালো মন্দ দেখে করি কিন্তু ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে পরিচয় গোপন রেখে যোগাযোগ করা সম্ভব। আর সেই যোগাযোগ আমাদের মানবিক গুণাবলিকে প্রভাবিত করছে। অনেক সময়েই এমন যোগাযোগ থেকে কোনও না কোনও ‘ভায়োলেন্ট’ প্রকাশ পাচ্ছে। মানি লন্ডারিং, আক্রমণাত্মক গেমস, পর্নোগ্রাফির মতো অপরাধেও জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভরতা থেকে একটি অপরাধী চক্র গড়ে উঠছে। আমরা যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নির্ভর তারাই আবার সেটাকে প্রচার করছি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক বলয় থেকে বের হয়ে আসতে হলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।
খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা খুবই খারাপ। এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে, মানসিকভাবে আমরা অনেকেই ‘আন-স্টেবল’ অবস্থায় আছি। এমন অবস্থা থেকে রাগ, ক্রোধ, অবসাদ ও বিষণ্নতার মতো নেতিবাচক আবেগ বের হয়ে আসে। আর সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাই আমাদেরকে মানসিকভাবে আগে সুস্থ হতে হবে।
আরবিসি/১৪ আগস্ট/ রোজি