আরবিসি ডেস্ক : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ফুডস ফ্যাক্টরিতে (সেজান জুসের কারখানা) লাগা আগুনে অন্তত ৫২ জন নিহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার রাসেল শিকদার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলো পাওয়া গেছে আগুন লাগা ভবনটির প্রথম থেকে চতুর্থ তলার মধ্যে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার উদ্ধার অভিযান এখনও শেষ হয়নি। সেখানে আরও মরদেহ থাকতে পারে।
এর আগে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন ৫০ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য দিয়েছিলেন। লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
নিহতদের অধিকাংশই শিশুশ্রমিক : প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে অনেক শিশুশ্রমিক রয়েছেন। পরিচয় শনাক্তের পর জানা যাবে সেখানে কতজন শিশুশ্রমিক ছিলেন। নিখোঁজ ইসরাত জাহান ফুলির (১৬) খোঁজে ঘটনাস্থলে এসেছেন বড় বোন লিমা। তিনি বলেন, ছোট বোন এখানে কাজ করে। তাকে খুঁজতে এসেছি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, টানাটানির সংসারে বোনকে কাজে পাঠাই। আমি নিজেও এখানে কাজ করি। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আগুন লাগার পর আমি বের হতে পারলেও ছোট বোন ফুলি বের হতে পারেনি।
ফুলির নাম নিখোঁজদের তালিকায় যুক্ত করেন রূপগঞ্জ থানার এসআই মিন্টু। আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানার ফটকের সামনে নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করছিলেন তিনি। ফুলির নাম তালিকার ৪৮ নম্বরে যুক্ত করা হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ তালিকার অনেকের বয়স ১৮ পার হয়নি।
১৪ বছর বয়সী ফারজানা গত তিন বছর ধরে পাঁচ হাজার টাকায় এ কারখানায় কাজ করছিলেন বলে জানান মা ঝরনা বেগম। মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে তিনি কারখানা এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন। ফারজানার সহকর্মী ১৬ বছর বয়সী মৌমিতা জানান, হাসেম ফুডস কারখানায় সেজান জুস, চানাচুর, সেমাই, চকলেটসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরি হতো। বৃহস্পতিবার বিকেলে যখন আগুন লাগে তখন কাজে ছিলেন না। এ কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন। কিন্তু ফারজানাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, তার বয়সী অনেক কিশোর-কিশোরী ছিলেন কারখানার মধ্যে। কম বয়সীদের সাধারণত রাতের শিফটে রাখা হতো না।
কম বয়সীদের কারখানায় কাজ করানোর বিষয়ে হাসেম ফুডসের কর্মকর্তাদের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রূপগঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত কমিটি : রূপগঞ্জে ভয়াবহ ওই অগিকাণ্ডের কারণে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম বেপারীকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। শুক্রবার (০৯ জুলাই) বিকেলে জেলা প্রশাসন থেকে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। তদন্ত কমিটি আগুন লাগার কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি দোষীদের শনাক্ত করবে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহ নুসরাত জাহান, জেলার ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন, জেলা পুলিশের একজন প্রতিনিধি এবং জেলা কলকারখানা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা।
এদিকে, সেজান জুস ফ্যাক্টরির অগ্নিদুর্ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। কমিটির সদস্যরা হলেন- পরিচালক (মেইনটেনেন্স অ্যান্ড অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান ২. উপ-পরিচালক নূর হাসান আহমদ ৩. সহকারী পরিচালক মানিকুজ্জামান ৪. উপ-সহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম ও সংশ্লিষ্ট ইন্সপেক্টর মো. শাহআলম।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশিষ বর্ধন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, হাসেম ফুডস কারখানার একটি সিঁড়ি বন্ধ না থাকলে অনেক প্রাণ বাঁচানো যেত। শুক্রবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ৪৯ জনের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আগের রাতে মারা যাওয়া তিনজনসহ নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ জনে।
দেবাশিষ বর্ধন বলেন, ‘আমরা মই সেট করে ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করি। বাকিরা যদি ছাদে উঠতে পারত, তাহলে বাঁচানো যেত।’
তিনি বলেন, ছয় তলা ভবনের ছাদে ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছে। যার একটির দরজা বন্ধ ছিল। চতুর্থ তলায় যারা ছিলেন, সেখান থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি তালাবন্ধ ছিল। আর নিচের দিকে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে ছিল ভয়াবহ আগুন। দগ্ধরা নিচের দিকেও আসতে পারেননি, তালাবন্ধ থাকায় ছাদেও যেতে পারেননি।’
কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল কি না— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তদন্ত-সাপেক্ষে বলা যাবে। তদন্ত কমিটি বের করবে কী কারণে আগুন লাগল, কত টাকার ক্ষতি হলো, অগ্নি নির্বাপত্তার ব্যবস্থা ছিল কি না।
এর আগে, ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক সিদ্দিক মোহাম্মদ জুলফিকার রহমান বলেন, কারখানার একেকটি ফ্লোর ৩৫ হাজার স্কয়ার ফিটের। সিঁড়ি মাত্র দুটি। সিঁড়িতেও আগুন ছিল, ফলে অনেকে বের হতে পারেননি। আমরা পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। অনেক বড় ফ্লোর এবং ভেতরে খোপ খোপ কক্ষ থাকায় আগুন নেভাতে সমস্যা হচ্ছে। ধোঁয়ার ফলে ছাদে উঠতেও ঝামেলা হচ্ছে।
‘দাহ্য ভোজ্যতেল’র কারণে আগুন বেশি সময় ধরে জ্বলেছে
আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানার ভেতরে প্রচুর ভোজ্যতেল পাওয়া গেছে, যার কারণে আগুন বেশি সময় ধরে জ্বলেছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসেন ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক মনির হোসেন ও পরিদর্শক ফখর উদ্দিন। শুক্রবার তাদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা বলেন, চার তলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একসঙ্গে অন্তত ২৫টি মরদেহ পাওয়া গেছে। সেখানে এক ধরনের নসিলা তৈরি হতো, যা তৈরিতে ভোজ্যতেল ব্যবহার করা হতো।
তারা বলেন, ভোজ্যতেলের কারণে এতক্ষণ ধরে আগুন জ্বলছে। এছাড়া প্রচুর প্লাস্টিক ও কাগজের কার্টুন সেখানে ছিল। ভোজ্যতেল পাইপের মাধ্যমে পুরো ফ্লোরে বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। সেই পাইপ ফেটে ভোজ্যতেল মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ফ্লোর পিচ্ছিল হয়ে যায়। সেখানে কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকজন কর্মী পিছলে পড়ে আহত হন বলেও জানান তারা।
গতকাল প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টার হাসেম ফুডস লিমিটেডের সাত তলা ভবনের নিচ তলার একটি ফ্লোরে হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। সময়ের সাথে সাথে আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় গোটা কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। এ সময় ঘটনাস্থলেই স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নামে দুই নারী শ্রমিক নিহত হন।
ফযধশধঢ়ড়ংঃ
হাসেম গ্রুপের এ কারখানায় বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আগুন লাগে। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি
রাত ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মোরসালিন (২৮) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়।
প্রাণে বাঁচতে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন অনেকে। লাফিয়ে পড়ে আহত হওয়া অন্তত ছয়জনকে গতকাল ঢামেকে ভর্তি করা হয়।
আগুন লাগার পর থেকেই শঙ্কা ছিল কারখানার ভেতর অনেক শ্রমিক হয়তো আটকা পড়েছেন। রাত ৯টার দিকে দেখা যায়, ভবনের সামনে ও পেছন দিক থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু আগুনের তীব্রতা বেশি ও প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারছিলেন না।
কারখানাটির সপ্তম তলায় একটি কেমিক্যাল গোডাউন ছিল বলে খবর পাওয়া গেছে। এই গোডাউনের কারণে আগুনের ব্যাপকতা বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরবিসি/০৯ জুলাই/ রোজি