স্টাফ রিপোর্টার : কোরবানীর ঈদের আগে কঠোর লকডাউন ও বিধি-নিষেধের মুখে কোরবানীযোগ্য পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রাজশাহীর হাজারো খামারী। খামারিদের প্রত্যাশা ছিল আসন্ন কোরবানি ঈদে ভালো দামে পশু বিক্রি করে গতবারের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া। তবে এবারও আশায় গুড়েবালি পড়েছে। করোনা রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধে চিন্তিত রাজশাহীর খামারি ও পশু ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে ছয় হাজার খামারির রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি গবাদি পশু। স্বাভাবিকভাবেই ঈদের একমাস আগেই ব্যস্ত সময় পার করেন রাজশাহীর পশু ব্যবসায়ী ও খামারিরা। এখন বিপুল সংখ্যক পশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তারা।
রাজশাহী জেলা প্রাণি সম্পদ অধিদফতরের সূত্রে জানা যায়, ঈদুল আযহা উপলক্ষে সাধারণত দুভাবে পশু প্রস্তুত হয়ে থাকে। এক হচ্ছে হৃষ্টপুষ্টকরণ পদ্ধতিতে অপরটি হচ্ছে বাসা-বাড়িতে লালন পালনের মাধ্যমে। দায়িত্বরত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায় থেকে এসব পশুর তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন বলে জানিয়েছেন জেলার অতিরিক্ত প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ও জেলা ট্রেনিং কর্মকর্তা।
রাজশাহী জেলা প্রাণি সম্পদ অধিদফতরের তথ্য মতে, জেলার ৯টি উপজেলা ও মহানগর এলাকা মিলিয়ে এবার মোট কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে সোয়া লাখের বেশি গরু। পবা উপজেলায় ৭০১ জন খামারির রয়েছে ২৯ হাজার ৪৩২টি পশু। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে- ষাঁড় আছে ৫ হাজার ৫২১টি, বলদ আছে ৬৭০টি, গাভী আছে ২৮৮টি, মহিষ আছে ৬৬টি, ছাগল আছে ২৮ হাজার ৩২৫টি, ভেড়া আছে ৮০৬টি ও অন্যান্য পশু রয়েছে ৩০১টি।
মোহনপুরে উপজেলায় ৬৩৬ জন খামারির রয়েছে ১ হাজার ২৯৫টি পশু। এরমধ্যে কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে- ষাঁড় আছে ৪৯৭টি , বলদ আছে ৬১টি, গাভী আছে ৫০৫টি, মহিষ আছে ৫৮টি, ছাগল আছে ১ হাজার ৭২১টি, ভেড়া আছে ১৯৭ ও অন্যান্য পশু আছে ৬৯ টি।
একমাস আগে থেকেই ব্যস্ত সময় পার করছেন রাজশাহীর পশু ব্যবসায়ী ও খামারিরা। এ লক্ষ্যে রাজশাহীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৭০৭টি গবাদি পশু। এবার কোরবানি ঈদে দেশের আভ্যন্তরে পালনকৃত গরু দিয়েই রাজশাহীতে কোরবানি দেয়ার মতো পশুর শতভাগ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। কিন্তু বিধিনিষেধের কারণে পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ী ও খামারিরা।
ছোটখাট খামারিদের মধ্যে তেমন কোনো চিন্তা কাজ না করলেও চরম দুশ্চিন্তায় আছেন বড় বড় খামারিরা। খামারে পালিত পশুগুলো ক্রেতা ধরার জন্য অনেকেই করছেন আগাম প্রচার-প্রচারণা। খামারিরা বলেন, ঈদের আগ পর্যন্ত এভাবে বিধিনিষেধ চলতে থাকলে অনেক বিপদে পড়বেন তারা। অন্তত কিছু দিনের জন্য হলেও রাজশাহীর সিটি হাটে পশু বিক্রির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তাদের ভাষ্য, আমরা লাভ চাইনা অন্তত আমাদের বিনিয়োগ ও খরচের টাকা উঠে আসুক। আবার খামারিদের একাংশের মনে সন্দেহ, হাট খুলে দিলেও কি হাটে ক্রেতা আসতে পারবে? ক্রেতা হাটে আসতে না পারলে হাট খুলে দিয়েও কোন লাভ হবে না, উল্টো ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
অনেকের দাবি, করোনাকালে আম ব্যবসায়ীদের যেভাবে বিক্রি ও সরবরাহ করতে দেয়া হয়েছে, ঠিক সেভাবে পশু ব্যবসায়ী ও খামারিদের জন্যও সুব্যবস্থা করা হোক। একইসঙ্গে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ রাখার দাবিও জানিয়েছেন খামারি ও পশু ব্যবসায়ীরা।
রাজশাহী নগরীর সপুরা আবাসিক এলাকায় ২০ বিঘা জায়গার ওপর চারটি শেডে ‘সপুরা এগ্রো ফার্ম’ নামের খামারে তিন বছর যাবত পশু পালন করছেন সুমন। প্রায় ২ কোটি টাকা বিনিয়োগ এই খামারে। খামারে রয়েছে প্রায় ১১০ পশু। এর মধ্যে গরু ৮৫টি ও মহিষ রয়েছে ২৫টি। এই খামারে কাজ করেন ছয়জন কর্মচারী। প্রতিমাসে তাদের বেতনসহ পশু পালনে খরচবাবদ গুনতে হয় ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা।
গত বছরের লাভ-লস ও আগামীতে কোরবানির বাজারের হিসেব কষে তিনি বলেন, ‘গত বছরে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছি। এবার ভেবেছিলাম কাটিয়ে উঠবো। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ১ জুলাই থেকে সাতদিনের কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে, তাই বন্ধ থাকবে সবকিছু। এদিকে খামারে রয়েছে প্রায় ২ থেকে ৩ কোটি টাকার বিক্রয়যোগ্য পশু। যার পেছনে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ। লাভ-লসের হিসেব কষতে গিয়ে রাতের ঘুম পর্যন্ত হারাম হয়ে গেছে। এবার প্রত্যাশা অনুযায়ী গরু বিক্রি করতে না পারলে গতবারের চেয়েও বেশি লসের আশঙ্কা তার।
নগরীর উপকণ্ঠের আরেক খামারি ইয়াসির আরাফাত রুবেল। ১০ শতাংশ জমিতে শেড তৈরি করে বানিয়েছেন খামার। সেই খামারে মোট ২৩টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন ১৪টি। এর আগে ঈদু ফিতরে বিক্রি করেছিলেন ছয়টি। তবে এবারে চলমান লকডাউনে গরু নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। তাই গরু বিক্রির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন অনলাইনে।
আরাফাত রুবেল বলেন, ‘খামারে কিছু কিছু ব্যাপারী আসছেন গরু দেখার জন্য। কিন্তু তেমন দাম বলছেন না। কোরবানিতে বিক্রির জন্য গরুর মাংসের দামের চেয়ে গরুর আকার-আকৃতি দেখে দাম নির্ধারিত হয়। আমার গরুগুলো আকার আকৃতিতে বেশ ভালো। এবার হাটে তুলতে পারলে ভালো দাম পাওয়া যেতো। কিন্তু করোনাকালীন পরিস্থিতি ভালো না দেখে অনলাইনে গরু বিক্রির চেষ্টায় আছি।’
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল জলিল বলেন, ‘আগামী ২১ জুন কোরবানি ঈদ। সেক্ষেত্রে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই হাট বসার কথা ছিল। কিন্তু করোনার ভয়াবহতার কারণে সরকার সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে। তাই আগামী ৭ জুলাইয়ের আগে সবকিছু বন্ধ থাকবে। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশুর হাট খোলার কোন সম্ভাবনা নেই।’
রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ও জেলা ট্রেনিং কর্মকর্তা মো. ইসমাইল হক বলেন, ‘এবার দেশেই পশুর পর্যাপ্ততা রয়েছে। রাজশাহী জেলাতেই রয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি কোরবানিযোগ্য গবাদি পশু। তাই পশুর যোগান বেশি থাকায় এবার হাটে-বাজারে খামারি ও ক্রেতা উভয়ের অনুকূলে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত থেকে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গরু আমদানি বন্ধের বিষয়েও সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে রাজশাহীর সবচেয়ে বড় ‘সিটি হাট’ বন্ধ থাকবে এক সপ্তাহ। এরমধ্যে কেউ চাইলে আমাদের প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল অনলাইন পেজে খামারিরা তাদের পশু সম্পর্কিত তথ্য দিতে পারেন। এক্ষেত্রে অনলাইনে কেনা-কাটার কিছু সুযোগ রয়েছে।
আরবিসি/০২ জুলাই/ রোজি