আরবিসি ডেস্ক : ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজ ১ জুলাই ১০০ বছর পূর্ণ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের এই দিনে পথচলা শুরু করা দেশের প্রধান এই প্রতিষ্ঠানের বয়স এখন গোটা এক শতাব্দী। কেমন ছিল এই কালভ্রমণ, তা রীতিমতো একটি গবেষণার বিষয়। তবে বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে প্রসিদ্ধ হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদান-অংশগ্রহণের জন্য, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বরাবরই নাম কুড়িয়েছে রাজনীতির পাতায় আঁচড় ফেলে।
১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণে’ এই অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া এ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে কোনো মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণি ছিল না। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরির লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার এ অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৯১২ সালের নাথান কমিশনের ও ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আইনসভা ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে পাস হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল অ্যাক্ট-১৯২০’। পরে ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সে সময় এই অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন কলকাতার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও হিন্দু নেতারা। এই দাবিতে তারা স্মারকলিপি পেশ, প্রতিবাদ সভা থেকে শুরু করে র্যালি পর্যন্ত আয়োজন করেছিলেন।
মাত্র তিনটি অনুষদ, ১২টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও তিনটি আবাসিক হল নিয়ে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট ও ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র ও ২০টি হল ও তিনটি হোস্টেল রয়েছে। নিয়মিত মোট ৩৭ হাজার ১৮ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক রয়েছেন ১ হাজার ৯৯২ জন। এ ছাড়াও অধিভুক্ত ১০৫টি কলেজ ও ইনস্টিউিটে ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন শিক্ষার্থী আছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অসামান্য অবদান। ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এই ভুখন্ডের মানুষের অধিকার আদায়ে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক প্রায় সবাই ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৪ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী দেশের তরে তাদের প্রাণোৎসর্গ করেন। এ ছাড়া নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা প্রধান ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন স্যার পি জে হার্টগ। এ ছাড়া পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ সি টার্নার, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, স্যার এ এফ রাহমান, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ প্রদান করেন যা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি ইলিশ মাছের জিন রহস্য উদঘাটন, শ্যাওলা থেকে ন্যানোফিল্টার ও একটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ‘হোমিকরসিন’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও এর উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য অবদান থাকলেও বর্তমানের এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা নেতিবাচক বিষয়ের জন্য আলোচনায় থাকছে। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাকে এর প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এক্ষেত্রে গবেষণা খাত বরাবরই অবহেলিত। ফলে এর প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকান্ডে। টাইমস হায়ার এডুকেশনের র্যাংকিং-এর ২০১৬ সালের সেরা ৬০০-৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে থাকা এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালের র্যাংকিং-এ ১০০০ এর পরে অবস্থান করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু ছাপিয়ে গেছে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি। অনেক শিক্ষক গবেষণা ছেড়ে রাজনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন প্রশাসনিক পদ বাগিয়ে নিতে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য ক্যাম্পাসে নষ্ট করেছে রাজনৈতিক সহাবস্থান। আবাসিক হলে সিট পেতে নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের অনুগত হতে হয়। তারপরও ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের কথা প্রায়ই শোনা যায়। দীর্ঘ ২৭ বছর পর ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হলেও সহসাই আর কোনো নির্বাচনের সম্ভাবনা নাকচ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ খুলে অতিরিক্ত ছাত্রভর্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতে অসামঞ্জস্য এনেছে। মোট শিক্ষার্থী সংখ্যার বিপরীতে নেই পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা। ফলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এ ছাড়াও হলগুলোতে অছাত্র ও বহিরাগতদের থাকার অভিযোগও রয়েছে।
একশ বছর পেরোলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম ডিজিটালাইজড করা যায়নি। ফলে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে নিয়মিত হয়রানির শিকার হন শিক্ষার্থীসহ অন্যরা।
ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কর্মসূচি :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে পতাকা উত্তোলন কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। গতকাল সকালে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনস্থ অ্যালামনাই ফ্লোর চত্বরে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে জাতীয় পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা ও অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে এক অনুষ্ঠানে অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত বছরব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধন ঘোষণা করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান।
অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে আজাদের সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল হক মুকুলের সঞ্চালনায় এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাড. মোল্লা মোহাম্মাদ আবু কাওছার, যুগ্ম-মহাসচিব সুভাষ সিংহ রায়, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মাহবুব হোসেন, অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন প্রমুখ।
উল্লেখ্য, সরকারি লকডাউনের ঘোষণায় একদিন আগেই এ কর্মসূচি পালন করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।
আরবিসি/০১ জুলাই/ রোজি