আরবিসি ডেস্ক : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুতই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এবারের পরিস্থিতি মারাত্মক রূপ নিতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। সংক্রমণ ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় সরকারও চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ডেলটা ভ্যারিয়েট এখন সংক্রমিত হচ্ছে, এটা অতি দ্রুত ছড়ায় এবং এর লক্ষ্য অনেক সময়ই আগে থেকে তেমন অনুভূত হয় না। যার কারণে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে।
এর আগে গত এপ্রিলে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেয়। তখন এক দিনে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ হাজারের বেশি আক্রান্ত ও এক দিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যু হয়েছিলো। এর পর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে যায়। কিন্তু চলতি জুনের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবার দ্রুত বাড়তো থাকে। ইতোমধ্যে সংক্রমণ ও মৃত্যু অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে। সোমবার (২৮ জুন) এক দিনে এযাবতকালের সর্বোচ্চ ৮০৬৪ জন শনাক্ত হয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের। এর আগের দিন ২৭ জুন সর্বোচ্চ ১১৯ জনের মৃত্যু হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা পরিস্থিতি দ্রুত বাড়তে থাকলেও দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষত্রে অনিহা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিকে অধিকাংশ মানুষ তোয়াক্কাই করছে না। দেশে করোনা আছে এটা অনেকে মনেই করে না। পাশাপাশি সরকার যে সব বিধি-নিষেধ জারি করছে, সেগুলো নামে মাত্রই, এর কোনো কার্যকারিতা নেই। কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় না। সরকার লকাডাউন বা শাটডাউন দিলেও তা কাগজপত্রে থেকে যায়। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। এ সব কারণে দ্রুত সংক্রমিত ডেলটা ভ্যারিয়েট দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং দিন দিন ভঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে বলে ওই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এদিকে সরকারের একাধিক সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হওয়ায় সরকারও তা মোকাবিলায় চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে দাঁড়াবে সেটা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। ইতোমধ্যে সরকার সীমিত পরিসরে ‘লকডাউন’ দিয়েছে। তবে আগামী ১ জুলাই থেকে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রথমে এক সপ্তাহের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পর তা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হতে পারে।
সোমবার (২৮ জুন) মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি আমরা। ১ জুলাই ভোর ৬টা থেকে ৭ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত খুবই কঠোর অবস্থানে যাচ্ছি আমরা।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সরকার যে সব উদ্যোগ নিয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা, আক্রান্ত ব্যক্তিকে আইসোলেসনে রাখাই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র উপায় বলে তারা জানান। এর জন্য প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও তারা সম্পৃক্ত করতে করতে বলেন। পাশাপাশি দ্রুত টিকার ব্যবস্থা করা এবং মানুষকে টিকা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রফেসর এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সংক্রমণ দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুতই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো আগে গ্রামে সংক্রমণ ছিলো না, এখন শহরের পাশাপাশি গ্রামেও সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে। এটা আরও বাড়তে থাকবে। ভারতীয় যে ধরণটি এখন দেখা যাচ্ছে সেটা অতি দ্রুত সংক্রমণশীল। এখন বড় সমস্যা যেটা সেটা হচ্ছে জনগণ স্বাস্থবিধির তোয়াক্কা করে না। অনেকেই মনে করে করোনা ভাইরাস বলে কিছু নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, মাস্ক পরা ছাড়া এ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর একটি সেটা হলো যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যে সব দেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পেরেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এবারের সংক্রমণের ধরণ একটু আলাদা। করোনা ভাইরাসের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং অতি সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি দ্রুত সংক্রমণশীল হওয়ার কারণে আগের চেয়ে আক্রান্ত ও মুত্যু আরও অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবার সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। সরকার লকডাউনের কথা বলছে, সেটায় কতটুকু কাজ হবে জানি না। কারণ অধিকাংশ উদ্যোগই কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানুষ মানছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে খুব অনিহাও রয়েছে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ বলেন, সংক্রমণের হার বর্তমানে ২৩ ভাগের উপরে। এই মুহূর্তে দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে। আমরা করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। যে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে সেটা অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্রুত সংক্রমণ ঘটে। এ কারণে চিন্তার বিষয় রয়েছে। আক্রান্ত যত বাড়বে মৃত্যুও তত বাড়বে। শাটডাউন দিলে সেটা কার্যকর করতে হবে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরকে সম্পৃক্ত করে গ্রাম শহরে সর্বত্রই বিধি নিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই আইসলেসনে নিতে হবে।
আরবিসি/২৮ জুন/ রোজি