আরবিসি ডেস্ক : বিটুমিন উৎপাদন হয় ইরানে। রপ্তানি প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত চীনা কিংবা অন্য কয়েকটি দেশের প্রতিষ্ঠান। শুধু জাহাজ বদল ও প্যাকেজিংয়ের কাজটা হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই)। আর তাতেই বিটুমিনভর্তি ড্রামের গায়ে লেখা হয়ে যাচ্ছে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন-ইউএই’। বিটুমিন আমদানিতে এ জালিয়াতি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশ ইরানের প্রস্তুতকৃত নিম্নমানের ভেজাল বিটুমিন হামেশা ঢুকছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এ বিটুমিনে সর্বনাশ হচ্ছে দেশের সড়ক-মহাসড়কের।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবার ইরানের পতাকাবাহী জাহাজেই বিটুমিন ঢুকেছে চট্টগ্রামে। আমদানি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ইরানের পণ্য খোদ ওই দেশের জাহাজে দেশে ঢোকার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে কোণঠাসা করে রাখতে পারে। আমদানিনিষিদ্ধ দেশের জাহাজ এবং ওই দেশের পণ্য এভাবে ঢুকতে থাকলে অর্থনৈতিকভাবে দেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সূত্র বলছেন, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে বিটুমিনভর্তি কয়েকটি জাহাজ নোঙর করে। এসব জাহাজের বিটুমিন খালাসও হয়ে গেছে। সর্বশেষ ১৭ জুন বৃহস্পতিবার জেটিতে ভেড়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্সের বিটুমিনের একটি জাহাজ। এর তিন দিন আগে ১৪ জুন জেটিতে পৌঁছায় আরেকটি জাহাজ, যেটি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিটুমিন নিয়ে এসেছে। আমদানি নথির তথ্যানুযায়ী দুটি জাহাজই এসেছে ইউএই বন্দর থেকে।
সূত্র জানান, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিটুমিন নিয়ে বন্দরে ঢোকে ইরানের পতাকাবাহী জাহাজ ‘নেগার’। জাহাজটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গিয়ে দেখা যায়, ইরানে নিবন্ধিত জাহাজটির আইএমও নম্বর ৯১৬৫৮৩৯। ২২ বছর ধরে চলমান জাহাজটির ধারণক্ষমতা প্রায় ২৩ হাজার টন। আইএমও নম্বর দিয়ে ট্র্যাকিং করলে দেখা যায়, জাহাজটি পণ্য খালাস করে ১৯ জুনই চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করেছে। মালয়েশিয়ার কেলাং বন্দরের দিকে যাচ্ছে জাহাজটি।
তথ্যমতে জাহাঙ্গীর অ্যান্ড আদার্সের বিটুমিনের ইনভয়েস ভেল্যু দেখানো হয়েছে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৩০১ ডলার। এ বিটুমিনের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম রাজ স্পেশালিটি কেমিক্যালস প্রাইভেট লিমিটেড। এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের চৌধুরী সিন্ডিকেটের নাম। অন্য জাহাজটির বিটুমিন রপ্তানি করেছে রোসনার হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেড। যেখানে বিটুমিনের ইনভয়েস ভেল্যু দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৫ ডলার। সব বিটুমিনই ৬০-৭০ গ্রেডের বলে উল্লেখ রয়েছে। রপ্তানিকারক দুটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজ স্পেশালিটি কেমিক্যালস মূলত প্রতিবেশী দেশের একটি প্রতিষ্ঠান। চেন্নাইতে এর প্রধান কার্যালয়। এ কোম্পানির অনেক কাজের একটি হলো বিটুমিন রপ্তানি। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ইরান থেকে বিটুমিনের সোর্সিং শুরু করে। এ ছাড়া গ্রাহকের নির্দেশনা অনুযায়ী শুধু আমিরাত থেকে পুনঃরপ্তানির কাজটিও করে দেয় তারা। অন্যদিকে রোসনার হোল্ডিং হংকংভিত্তিক একটি কোম্পানি। হংকংয়ে প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি চীনের সাংহাই, ইউরোপের নেদারল্যান্ডস ও ইথিওপিয়ায় কোম্পানির কার্যালয় আছে। মজার তথ্য হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কোম্পানিটির কোনো কার্যালয়ই নেই। অথচ ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিটুমিন আমদানির নথিতে এ কোম্পানিটিকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করতে মেইল করা হলেও তাদের সাড়া মেলেনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট সূত্র নিশ্চিত করেছেন, ইউএইতে বিটুমিনের কোনো কারখানা নেই। দেশটি বিটুমিন উৎপাদনই করে না। মূলত পাশের দেশ ইরান থেকে বিটুমিনের চালান সে দেশে ঢোকার পর সেগুলো রিফাইন হয়। তারপর তা বিভিন্ন দেশে পুনরায় রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কনস্যুলেট সূত্র আরও জানান, আবুধাবি, হামরিয়াহ উন্মুক্ত জোন, ফুজাইরাহ ও আজমানে রিফিলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ইউএই সূত্র জানান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আমিরাতের বিভিন্ন বন্দরসংলগ্ন এলাকায় বিটুমিনের ডিপো স্থাপন করেছে। ইরানের উৎপাদিত বিটুমিন প্রথমে এসব ডিপোয় রাখা হয়। তারপর ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী প্যাকেজিং শেষে পুনরায় রপ্তানির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
দুবাইভিত্তিক বিটুমিন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইনফিনিটি জেনারেল ট্রেডিং এফজেডইর সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ব্যবস্থাপক টিনা তাঘাভি জানান, ইউএইর কোথাও তাদের বিটুমিনের কোনো প্লান্ট নেই। মূলত প্রতিবেশী একটি দেশ থেকে তাদের চাহিদামতো বিটুমিন আসে। ইরানের আল আব্বাস পোর্ট থেকে বিটুমিনের জাহাজ সরাসরি এসে ভেড়ে ইউএইর জেবেল আলী পোর্টে। সেখানে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী নতুন লেবেল লাগিয়ে তা পুনঃরপ্তানি করা হয়। অন্যদিকে ইরানের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও জানা গেছে তাদের বিটুমিন বিক্রির নানা বিষয়। ইরানের ইস্পাহানের সেগঝি ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে অবস্থিত ইস্পাহান বিটুমিন প্রোডাকশন কোম্পানি। এক বিক্রয় কর্মকর্তা জানান, নিয়মিতই তারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বিটুমিন বিক্রি করছেন। তবে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকায় সরাসরি তার কোম্পানি রপ্তানি করে না। তাই সংশ্লিষ্ট ক্রেতার দেশে বিটুমিন পৌঁছে দিতে তাদের দ্বারস্থ হতে হয় ইউএইভিত্তিক কোনো সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। অনুসন্ধানী তথ্যমতে ইউএইতে বিটুমিনের কোনো প্লান্ট না থাকা এবং দেশে ঢোকা সব বিটুমিনের উৎপাদন ইরানে হলেও দেশের আমদানিকারকরা সব সময় দাবি করে আসছেন এগুলো আমিরাতের তৈরি। আমদানিকারক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে মানহীন বিটুমিন ছড়িয়ে পড়ায় বিভিন্ন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জানা গেছে, প্রভাবশালী আমদানিকারকদের বিটুমিন আমদানির কৌশলের কাছে টিকছে না সরকারের প্রজ্ঞাপনও। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও সে নির্দেশনা উপেক্ষিত। পরীক্ষা ছাড়াই কৌশলে ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে বিটুমিনের জাহাজ। এর আগে রবিবার পিএইচপি গ্রুপ ও ইলিয়াস ব্রাদার্সের ১১ হাজার টনের বেশি বিটুমিন বহনকৃত জাহাজ পরীক্ষা ছাড়াই খালাস হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার তোফায়েল আহমেদ জানান, বিটুমিন আমদানি নিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে মান যাচাই করা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশ থেকে বিটুমিন আমদানি প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। এটা নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আমরা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিটুমিনের গুণগত মান যাচাই হচ্ছে কি না তা দেখেই বন্দর থেকে পণ্য খালাসের অনুমতি দিচ্ছি। এর বাইরে আমরা কিছু বলতে পারব না।’
আরবিসি/২২ জুন/ রোজি