স্টাফ রিপোর্টার : রাজশাহী বিভাগে করোনার ‘হট স্পট’ এখন রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরই মধ্যে ভারত সীমান্তবর্তী এ দুই জেলায় ‘বিশেষ লকডাউন’ চলছে। কিন্তু এর পরও থামছে না মৃত্যুর মিছিল। পরিস্থিতি যেন ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ লকডাউনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এজন্য এখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তাই কেবল লকডাউন দিয়েই হবে না ভাবতে হবে ভিন্ন কৌশলও। গেল ২৪ ঘণ্টায়ও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে করোনাকাল শুরু থেকে (গত বছরের ২৫ মার্চ) সোমবার (২১ জুন সকাল ৮টা) পর্যন্ত ৭৩৯ জনের মৃত্যু হলো। আর বিভাগের আট জেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৪৮ হাজার ৫৬ জন।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় থেকে সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নাজমা আক্তার বাংলানিউজকে জানান, বিভাগে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান রয়েছে গত বছরের ২৫ মার্চ সর্ব প্রথম লকডাউন ঘোষণার পর থেকে এ বছরের ২১ জুন পর্যন্ত।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে রাজশাহী বিভাগের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. নাজমা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, সোমবার বিভাগে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফলে বিভাগে আজ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩৯ জন। এর মধ্যে বিভাগের রাজশাহীতে ১২৪ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯১ জন, নওগাঁয় ৬৪ জন, নাটোরে ৪২ জন, জয়পুরহাটে ২০ জন, বগুড়ায় ৩৪৮ জন, সিরাজগঞ্জ ২৮ জন ও পাবনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিভাগে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বগুড়ায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২৪ জন মারা গেছেন রাজশাহী জেলায়। রাজশাহীর এই আট জেলায় আজ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৫৬ জন।
এর মধ্যে বিভাগের রাজশাহী জেলায় ৮ হাজার ৮৮৩ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ হাজার ৩০৪ জন, নওগাঁয় ২ হাজার ৪২৩ জন, নাটোরে ১ হাজার ৫৫৯ জন, জয়পুরহাটে ১ হাজার ৭৩৮ জন, বগুড়ায় ১২ হাজার ২০৬ জন, সিরাজগঞ্জে ৩ হাজার ৯১ জন ও পাবনায় ৩ হাজার ৩৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন- ৩৫ হাজার ৫৭৬ জন। এ পর্যন্ত রাজশাহী বিভাগের আট জেলার প্রতিটি বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন- ৪ হাজার ৭৬২ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী।
স্বাস্ব্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার রাজশাহী অঞ্চলের সহকারী পরিচালক ডা. নাজমা আক্তার আরও বলেন, ‘রাজশাহীতে করোনা সংক্রমণ এখন ‘পিক টাইম’ বা সর্বোচ্চ অবস্থা চলছে বলে আমরা ধারণা করছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে এটিকে আর বাড়তে না দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সর্বাত্মক লকডাউনের পাশাপাশি সর্চোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এখন আর কোনো বিকল্প নেই। আর সঠিক নিয়মের মাস্ক ব্যবহার করলে ভারতীয় বা যে কোনো ভেরিয়েন্টের সংক্রমণই প্রতিরোধ করা সম্ভব’।
এদিকে করোনা সেবায় রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের সর্বোবৃহৎ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (২১ জুন) দুপুরে প্রেস ব্রিফিং করা হয়েছে। এতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী প্রথমেই করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। পরে রাজশাহীসহ আশপাশের জেলার করোনা পরিস্থিতির বিভিন্ন তথ্য সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করেন।
এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘বিশেষ লকডাউন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের দেরি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালের করোনা ইউনিটে করোনা আক্রান্ত হয়ে এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬২ জন’।
এছাড়া আজ সোমবার (২১ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ৪০২ জন। এর মধ্যে রাজশাহীর ২৬৪ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৭০ জন, নাটোরের ৩০ জন, নওগাঁর ২৯ জন, পাবনার ৫, কুষ্টিয়ার ২ জন এবং চুয়াডাঙ্গার দুজন রয়েছেন। আগের দিন ভর্তি ছিলেন ৩৭৭ জন। বর্তমানে হাসপাতালে করোনা ডেডিকেটেড শয্যার সংখ্যা ৩০৯টি। আর যারা আছেন তাদের সবারই অক্সিজেন প্রয়োজন পড়ছে। হাসপাতালের বেড সংখ্যা বাড়িয়েও রোগীদের সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই পরিস্থিতি উত্তরণে শুধু লকডাউনের ওপর নির্ভর না থেকে ভিন্ন কোনো কৌশলও খুঁজতে হবে। এর পাশাপাশি সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্কতার সাথে থাকতে হবে।
একই কথা উল্লেখ করেন রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. হাবিবুল আহসান তালুকদার।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই। সবাইকে সরকারি নির্দেশনা মেনে ঘরে থাকতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হলে অবশ্যই সঠিক উপায়ে মুখে মাস্ক পড়তে হবে। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং চলমান লকডাউনে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাহির না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য পরিচালক।
এদিকে ভারত সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহীতে গত ১১ জুন থেকে চলছে ‘বিশেষ লকডাউন’। এরপরও রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। সেই সঙ্গে রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করোনা রোগীদের জায়গা দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় হাসপাতালের আরও একটি সাধারণ ওয়ার্ডকে কোভিড ওয়ার্ডে রূপান্তরের কাজ চলছে। এখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২৯-৩০, ৩৯-৪০, ২৫, ২২, ২৭, ১৬, ১৫, ৩ এবং ১ নম্বর ওয়ার্ডে করােনা আক্রান্ত রােগীদের চিকিৎসা চলছে। এছাড়া নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ২০টি ও কেবিনে ১৫টি করোনা ডেডিকেটেড শয্যা আছে। সবমিলিয়ে মোট শয্যার সংখ্যা ৩০৯টি।
করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডটিতে এখন অক্সিজেন সরবরাহ লাইনের কাজ চলছে। এই ওয়ার্ডে ৩৬টি শয্যা আছে। সেখানে বারান্দায় আরও বাড়তি ১২টি শয্যার ব্যবস্থা করা যাবে। ফলে সেখানে মোট ৪৮ জনের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ লাইনের কাজ শেষ হলে এই ওয়ার্ডটিও যুক্ত হবে। এতে শয্যা সংখ্যা বেড়ে ৩৫৭টিতে দাঁড়াবে।
আরবিসি/২১ জুন/ রোজি