আরবিসি ডেস্ক : বাংলাদেশ থেকে তাঁদের চূড়ান্ত গন্তব্য ছিল ইতালি। ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে গৃহযুদ্ধকবলিত লিবিয়ায় পৌঁছান তাঁরা। এরপর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগরের দুর্গম পথে যাত্রা ইতালির উদ্দেশে। মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে গত এক মাসে এভাবে ইউরোপ পাড়ি জমাতে যাওয়া লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায় ৫২৯ জন বাংলাদেশি উদ্ধার ও আটক হয়েছেন। এর মধ্যে তিউনিসিয়াতেই উদ্ধার হয়েছেন ৪৪৩ জন। এই ৪৪৩ জনের মধ্যে আবার ১৬৪ জন উদ্ধার হয়েছেন গত বৃহস্পতিবার তিউনিসিয়া উপকূল থেকে।
লিবিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার ক্ষেত্রে নৌকা ডুবে প্রায়ই অভিবাসীর মৃত্যুর খবর শোনা যায়। এ ছাড়া ওই দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকও হন অনেকে। এরপরও বিপজ্জনক এ পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপ পাড়ি জমানোর প্রবণতা থামছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার সময় গত ১৮ মে ৩৬ জন, ২৭ ও ২৮ মে দেশটির উপকূল থেকে ২৪৩ জন এবং ১০ জুন ১৬৪ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড। এ ছাড়া গত মাসে লিবিয়ার অবৈধ অভিবাসন দমন বিভাগের (ডিসিআইএম) কর্মকর্তারা আলজেরিয়ার সীমান্তবর্তী মরু এলাকা দারাসে অপহরণকারীদের কবল থেকে ৮৬ জন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছেন। তাঁরা বেনগাজি হয়ে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার পথে অপরহণকারীদের কবলে পড়েছিলেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গতকাল রোববার বলেন, গত বৃহস্পতিবার উদ্ধার হওয়া ১৬৪ জনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস তিউনিসিয়ার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে। এর আগে মে মাসে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের বড় অংশের সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তিউনিসিয়া গিয়ে কথা বলেছেন। ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিনিধিদল তিউনিসিয়ার পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সে দেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ এবং আইওএম, আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও তিউনিসিয়ার রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
■ মে মাসে লিবিয়ার মরুভূমি থেকে উদ্ধার ৮৬ জন বাংলাদেশি। ■ মানব পাচারকারীদের কবলে পড়া ১৬০ জন গত মাসে দেশে ফিরেছেন। ■ ২০১৫ সালের পর লিবিয়া থেকে ফিরেছেন ২ হাজার ৯০০ জন। ■ চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু।
লিবিয়ায় বাংলাদেশের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত) গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ডের সহায়তায় গত এক মাসে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে ২২১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মানব পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া ওই ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দুবাই থেকে একটি ভাড়া করা উড়োজাহাজে করে তাঁদের লিবিয়ার বেনগাজিতে নেওয়া হয়। এরপর ডিঙি নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার যাত্রা শুরু হয়। দুবাই থেকে যাত্রার আগে তাঁদের সবাই ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশে গিয়েছিলেন। এরপর অন্তত সাত থেকে আট দিন তাঁদের সবাই দুবাইয়ে থেকেছেন।
জানতে চাইলে গাজী মো. আসাদুজ্জামান কবির গতকাল ত্রিপোলি থেকে মুঠোফোনে বলেন, ‘সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর ওই ২২১ জন বাংলাদেশির জন্য তিউনিসিয়ার অভিবাসন অধিদপ্তর, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাসহ (আইওএম) স্থানীয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে জারজিস, মেদনিন, জারবাহ, স্ফ্যাক্স ও মাহদিয়া শহরে প্রাথমিক শেল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন শেষ করে এখন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও আইওএম কর্তৃক পরিচালিত শেল্টার হাউসে অবস্থান করছেন। এ ছাড়া তাঁদের মধ্যে যাঁরা দেশে ফিরতে আগ্রহী, তাঁদের আইওএমের সহযোগিতায় দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রতিনিধিদল লিবিয়ার গাদামেস শহরের কাছে একটি আটককেন্দ্রে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের কাউন্সেলিং করেছে। লিবিয়া অবজারভার জানায়, চলতি বছর দেশটির কোস্টগার্ড সমুদ্র থেকে ৯ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গত বছর উদ্ধার করা হয় সাত হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীকে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুসারে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরে ৮১৩ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। মানব পাচারকারীদের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া ১৬০ জন বাংলাদেশি গত মে মাসে আইওএমের সহায়তায় দেশে ফিরেছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত সংস্থাটির সহায়তায় ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ২ হাজার ৯০০ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন।
আরবিসি/১৪ জুন/ রোজি