আরবিসি ডেস্ক : মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে জনজীবন ও সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দেশের শেয়ারবাজারে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। করোনার প্রকোপ চলাকালে প্রায় এক যুগের মধ্যে সব থেকে ভালো সময় পার করছে দেশের পুঁজিবাজার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু বাংলাদেশ নয় করোনার মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশের শেয়ারবাজার বেশ ভালো করছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের ভালো করার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা না।
তারা বলছেন, করোনার মধ্যে মানুষের বিকল্প বিনিয়োগের সুযোগ নেই। ব্যাংকের সুদের হার কম। আবার বাজারে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজারে টানতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তার প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। আতঙ্কে ওই দিন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ৯৭ পয়েন্ট পড়ে যায়। পরের দিন ৯ মার্চ আরও বড় ধস নামে বাজারে। একদিনে ২৭৯ পয়েন্ট কমে যায় ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক। এ সময় লোকসানের আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে অনেকে শেয়ারবাজার ছাড়েন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় টানা ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয় শেয়ারবাজারের লেনদেন। এর মধ্যেই বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেবে যোগ দেন আরও তিনজন। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করার উদ্যোগ নেন। ফলে টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ মে থেকে শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু হয়।
নতুন নেতৃত্বের অধীনে শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু হলেও অব্যাহত থাকে লেনদেন খরা। তবে জুলাই মাসে এসে অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় নতুন কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)।
সেই সঙ্গে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজনের বেশি দুর্বল কোম্পানির আইপিও। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপের ফলে ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার।
তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। আর করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলে মার্চের শেষ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ এক প্রকার ধস নামে শেয়ারবাজারে। অবশ্য করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার ‘লকডাউন’ দিলে শেয়ারবাজার বেশ তেজি হয়ে উঠে।
আতঙ্ক কাটিয়ে লকডাউনের মধ্যে হু হু করে বাড়ে লেনদেন, সূচক ও বাজার মূলধন। এতে বিনিয়োগকারীদের মুখেও হাসি ফুটেছে। ৫০ কোটি টাকার নিচে নেমে যাওয়া লেনদেন এখন দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া অনেকটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে।
শেষ ২৬ কার্যদিবস টানা হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই)। এর মধ্যে শেষ পাঁচ কার্যদিবস দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এমনকি এর মধ্যেই ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ডও হয়েছে। সবশেষ আজ বুধবারও (৯ জুন) শেয়ারবাজারে ব্যাপক তেজিভাব দেখা যাচ্ছে। প্রথম আধাঘণ্টার লেনদেনে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ৫০ পয়েন্টের বাড়ার পাশাপাশি লেনদেন সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে যে দিন প্রথম করোনা শনাক্ত হয় অর্থাৎ গত বছরের ৮ মার্চ ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল চার হাজার ২৮৭ পয়েন্টে। চলতি বছরের ৮ জুন লেনদেন শেষে তা বেড়ে ছয় হাজার ২৩ পয়েন্টে উঠে এসেছে। অর্থাৎ করোনার মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক বেড়েছে এক হাজার ৭৩৬ পয়েন্ট।
সূচকের পাশাপাশি বড় উত্থান হয়েছে বাজার মূলধনে। করোনার মধ্যে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে এক লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। বাজার মূলধন বাড়ার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম ওই পরিমাণ বেড়েছে। এ হিসাবে করোনার মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা বেড়ে গেছে।
শেয়ারবাজারের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএসইর পরিচালক মো. শাকিল রিজভী বলেন, গত বছর প্রথম যখন বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়, সবার মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। সার্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যার প্রেক্ষিতে শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। তবে সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনীতিতে খুব একটা বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। যে কারণে শেয়ারবাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো থাকার পাশাপাশি ব্যাংকের সুদের হারও গত এক বছরে বেশ কম রয়েছে। এর সঙ্গে কমিশনের নতুন নেতৃত্ব বাজার ভালো করতে বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। অনিয়ম করায় বিএসইসি অনেককে জরিমানা করেছে। পাশাপাশি কিছু দুর্বল কোম্পানির আইপিও বাতিল করেছে। আবার আইপিও আবেদন করার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে সুযোগ দেয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে করোনার মধ্যে ভালো করেছে শেয়ারবাজার।
ডিএসইর আরেক পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ২০১০ সালের পর গত এক বছর শেয়ারবাজার সব থেকে ভালো সময় পার করেছে। এর অন্যতম একটি কারণ সুদের হার কম থাকা। ব্যাংকে টাকা রাখলে এখন খুব একটা মুনাফা পাওয়া যায় না। বরং শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ব্যাংকের থেকে অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। আবার ঘরে বসেই মোবাইল, ই-মেইলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারেন। এসবের ইতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারে দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশের শেয়ারবাজার না ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেও করোনার মধ্যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও শেয়ারবাজারকে ‘ফটকা বাজার’ বলা হয় না। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে শেয়ারবাজারকে ‘ফটকা বাজার’ বলতে শোনা গেছে। এ বছর জাতীয় সংসদে সব থেকে বেশি শেয়ারবাজারের সমালোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজারে কিছু হলেই সরকারকে দোষ দেয়া হয়। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের ধসের ঘটনায় সরকারকে দোষারোপ করা হয়েছে। এটা ঠিক না। শেয়ারবাজারে যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে তার দেখার দায়িত্ব বিএসইসির। কোনো আইনের লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে বিএসইসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বিএসইসি ব্যর্থ হলে তার দায় কমিশনকে নিতে হবে। এর দায় তো সরকারের হতে পারে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, করোনার কারণে এখন মানুষের বিকল্প বিনিয়োগের পথ কম এবং ব্যাংকের আমানত ও এফডিআর’র সুদের হার বেশ কম। এর সঙ্গে বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারী টানতে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সবকিছু মিলেই করোনার মধ্যে শেয়ারবাজার বেশ ভালো করেছে।
তিনি বলেন, শেয়ারবাজার এখন বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। তবে বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে- শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে যেমন মুনাফা পাওয়া যায়, তেমন লোকসানেরও শঙ্কা রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ইতোমধ্যে অতিমূল্যায়িত হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের এসব শেয়ারে ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, করোনার মধ্যে শেয়ারবাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়া বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। বিশ্বের অনেক দেশেই করোনার মধ্যে শেয়ারবাজার ভালো অবস্থায় রয়েছে। এখন ব্যাংকের সুদের হার কম এবং বিএসইসির নতুন নেতৃত্ব বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব কারণে আমাদের শেয়ারবাজার করোনার মধ্যে ভালো করছে। তবে শেয়ারবাজারে এখনও সুশাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আরবিসি/০৯ জুন/ রোজি