স্টাফ রিপোর্টার : পবিত্র কোরআনে বর্ণিত মরুভূমির মিষ্টি ফল ত্বীন। রসে ভরপুর, মিষ্টি ও সুস্বাদু এ ফল বরেন্দ্র ভূমি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মাটি ও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিয়েছে। দিনে দিনে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর। তাই চাষাবাদে বৈচিত্র্য আনছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা। খরাসহিষ্ণু ফসলের তালিকায় এবার বরেন্দ্র ভুমি রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে যোগ হলো মিশরের ‘ত্বীন’ ফল।
গোদাগাড়ী উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে নতুন এ ফলের চাষ করছেন কৃষক রকিবুল আলম রাজু (৪২)। কৃষিবিদরা এটাকে মিশরীয় ডুমুর বলছেন। এ দেশের তাপমাত্রায়ও ত্বীন মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। বিভিন্ন রঙের এ ফলের ফলনও ভালো।
সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এ ফলকে ত্বীন বললেও অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্দান ও যুক্তরাস্ট্রে এটি আঞ্জির নামে পরিচিত। ত্বীন ফল বাংলাদেশে ডুমুর হিসেবেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে ত্বীন ফলকে বলা হয় দ ফিগ।
সবুজ লকলকে প্রসারিত শ্যামল পাতার ত্বীন গাছগুলো লম্বায় ৮ থেকে ১০ ফুট পর্যন্ত। বর্ষা ও শীতে ফল কম হলেও বছরের অন্যান্য সময়ে প্রতিটি পাতার গোড়ায় জন্মে একটি করে ফল। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডুমুর আকৃতির এ ফল সবার দৃষ্টি কেড়েছে।
মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ত্বীন ফল পাকতে শুরু করে। পাকলে লাল, খয়েরি, গোলাপি ও হলুদাভ রঙ ধারণ করে আশ্চর্য এ ফল। ফলের আকারও বড় হয়। পুরোপুরি পাকলে রসে ঠাসা ও মিষ্টি হয়ে ওঠে।
কৃষক রকিবুল আলম রাজু জানান, তিনি ঢাকা শহরে ব্যাবসা করতেন। গতবছর লকডাউন শুরু হলে ক্রমশ ব্যাবসার পুঁজি হারাতে বসেন। তখন তার ভাগিনা ত্বীন ফল চাষের পরার্মশ দিলে তিনি ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ী চলে আসেন। ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি গড়ে তুলেন কৃষি খামার। বিভিন্ন ফল চাষের পাশাপাশি ১ বিঘা জামিতে তিন প্রজাতির ত্বীন চাষ করে।
তিনি জানান, ঢাকার গাজীপুর মান্ডইল থেকে ৩০০ চারা এনে তিনি জমিতে রোপণ করেন। এতে তার খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। গতবছরের নভেম্বরে চারা রোপণ করেন। পাঁচ-ছয় মাস পর গাছে ফল আসতে শুরু করেছে। এখন দু’একটি করে ফল পাকতেও শুরু করেছে।
রাজু আশা করছেন, মাস খানেকের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পাকবে এবং তিনি তা বাজারজাত করতে পারবেন। রাজু বলেন, ঢাকার বাইরে ফলটি এখনও তেমন পরিচিত নয়। তবে ঢাকায় এ ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন সুপারসপগুলোতে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এ ফল। রাজশাহীতেও তিনি এ ফলের বাজার সৃষ্টি করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও জানান, তার এ ফলের বাগান দেখতে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছেন। এদের অনেকে চারা সংগ্রহ করার জন্যও বলে রাখছেন। বরেন্দ্র অঞ্চলে এ ফলের চাষ বাড়াতে তিনি গাছে কলম করে আগ্রহীদের দেবেন। গাছে তেমন রোগ-বালাই নেই বলেও জানায় রাজু।
কৃষিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ত্বীন ফল বাংলাদেশে ড্রাই ফুড হিসাবে আমদানি করা হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন বাড়ানো গেলে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণে তা সহায়ক হতে পারে। ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধে এ ফল খুবই উপকারী। এ ছাড়া নানা রোগ নিরাময়ে বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ত্বীন। পুষ্টি চাহিদা পূরণেও ত্বীন গুরুত্বপূর্ণ।
প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি ১, ভিটামিন বি ২, ছাড়াও প্রায় সব রকমের জরুরি নিউট্রিশনস যেমন ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, সোডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, পটাশিয়াম ইত্যাদি আছে। ভিটামিন-এ, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের অভাবজনিত রোগে এটি বেশ কার্যকরী। কার্বোহাইড্রেট, সুগার, ফ্যাট, প্রোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন ছাড়াও বিভিন্ন পুষ্টিগুণে ভরপুর এ ডুমুর। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি ডুমুরের অনেক ওষধী গুণও রয়েছে।
প্রতিটি গাছ থেকে প্রথম বছরে এক থেকে দুই কেজি, দ্বিতীয় বছরে ৭ থেকে ১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ কেজি পর্যন্ত ফল ধরে। এভাবে ক্রমবর্ধিত হারে একটানা ৩৪ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে। গাছটির আয়ু প্রায় ১০০ বছর। তিন মাসের মধ্যেই শতভাগ ফলন আসে। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ডুমুর আকৃতির এ ফল। প্রতিটি পাতার গোড়ায় গোড়ায় ফল হয়।
স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা অতনু সরকার বলেন, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ রসালো এ ফলটি হাল্কা মিষ্টি স্বাদের। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী ফল। এ ফলের আকার এবং আকৃতি অনেকটা ডুমুরের মত। তবে ত্বীন ফল আকৃতিতে বেশ বড়। বাংলাদেশের মাটিতে আকারে ছোট হয়। এখানে একটি পরিপক্ক ফলের ওজন ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম। রঙ খয়েরি লাল। রাজুর চাষাবাদে যেন কোন সমস্যা না হয়, তার জন্য তিনি জমিতে গিয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেন।
তিনি আরও জানান, গাছ থেকে একবার ফল আহরণের দেড় মাস পর আবারও ফল আহরণ করা যাবে। একটি গাছ থেকে এক মৌসুমে গড়ে তিন কেজির মতো ফল পাওয়া যাবে। পরবর্তিতে আরো ফল বৃদ্ধি পাবে। গাছের আয়ুষ্কালও অনেক বেশি। এ ফল চাষে পানি কম লাগে, কাজেই বরেন্দ্র অঞ্চলে এ ফলের চাষে কৃষক লাভবান হতে পারেবে বলেই আশা করছেন অতনু সরকার।
আরবিসি/০২ জুন/ রোজি