আরবিসি ডেস্ক : আসন্ন ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাসের কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা দেখা গেছে। তাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘ফাটল’ সারাতে এবারের বাজেটে এ খাতের গুরুত্ব বাড়বে। এদিকে মহামারিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে— সরকার এমন বাজেট ঘোষণা করবে বলে আশা করছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে করের নেটওয়ার্ক (করজালের বিস্তৃতি) ছোট, এটা বাড়াতে হবে। আবার কেউ একবার করের জালে ঢুকে গেলে পরে ঝামেলায় পড়তে পারে— এই ভয়ে অনেকেই কর দেন না। এ ধরনের ভীতি যে কারণেই আসুক তা দূর করতে হবে। দেশে করপোরেট (কোম্পানি পর্যায়ে) করহার অনেক বেশি, এটা কমাতে হবে। বিভিন্ন দেশে করহার কমিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সুযোগ করে দেয়া হয়। এতে ব্যবসা যত প্রসার হবে রাজস্ব আয় তত বাড়বে। আমাদের দেশে করের চাপে ব্যবসা করা কষ্টকর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আসছে বাজেটে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি, ব্যবসা খাতেও গুরুত্ব দিতে হবে। সরকার ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সময়ে যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।
সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতির বাজেট আসছে। মোট জিডিপির তুলনায় ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৬ শতাংশ। তবে আগের অর্থবছরগুলোতে বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছিল ৫ শতাংশের নিচে।
আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্যখাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের কোনো দ্বিমত নেই। তবে মহামারির কারণে ‘চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়ার কথা বলছেন তারা। ব্যবসায়ীরা আসন্ন বাজেটে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চান, যাতে করভীতি দূর হয়ে করজালের পরিধি বাড়ে।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ বাজেট নিয়ে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা অনেক আশাবাদী। করোনায় এ খাত অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পোশাক খাতের জন্য অনেক সহায়তা প্রয়োজন। নতুন বাজারের জন্য পোশাক খাতে ৪ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে, যেটা ৫ শতাংশ করার দাবি জানাই। ম্যান মেইড ফাইবারের ওপর ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হলে রফতানি আয় আরও বেড়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘গত দেড় বছর দেশে তেমন আশানুরূপ বিনিযোগ হয়নি। এ কারণে কর্মসংস্থানও তেমন বাড়েনি। এক্ষেত্রে ট্যাক্সের বোঝা কমানো হলে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। মোট কথা, দেশে বিনিয়োগ বাড়াতে করের বোঝা কমাতে হবে। এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বেকারত্বও কমে আসবে। পোশাক খাতে উৎসে আয়কর কমাতে হবে।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মহামারির কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ক্ষতির মুখে ট্যাক্সে যেন চাপ না আসে, আসছে বাজেটে এই সে প্রত্যাশা। আমরা ৪০ শতাংশ গ্রোথ ধরে বাজেট করি। কিন্তু অর্জন ১৪ থেকে ১৮ শতাংশের বেশি হয় না। এখানে ২০ শতাংশ গ্রোথ ধরে বাজেট করলে বাড়তি যে ২০ শতাংশের চাপ, সেটা আর পড়ে না। আশা করবো, এবারের বাজেটে ২০ শতাংশের ওপরে গ্রোথ রেট দেয়া হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশে করের চাপে ব্যবসা করা কষ্টকর। নতুন বাজেটে এটা কমানো দরকার। করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলেও রেভিনিউ (রাজস্ব) যেন না কমে, সেটার জন্য করনেট স্প্রেড (করজালের বিস্তৃতি) বাড়ানো দরকার। দেশে কর নেটওয়ার্ক ছোট এটা বাড়াতে হবে। এখন এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) লোকবলের ঘাটতি নেই, নিয়োগ হয়েছে অনেক।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘গ্রামেও অনেক মানুষের কাছে টাকা-পয়সা আছে। তারা ট্যাক্স দিতে পারবে। এক্ষেত্রে থানা-ইউনিয়ন পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও রিটেইলারদের ভ্যাট-ট্যাক্স সহজ করা হোক। যারা ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়েছিলেন, এখন যারা দিতে পারছেন না এক্ষেত্রে মামলা হচ্ছে। মামলা চালাতে খরচ হচ্ছে দেড় হাজার কোটি টাকা। অথচ তাদের কাছে পাওনা হয়তো ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ‘কেউ একবার করের জালে ঢুকে গেলে পরে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে— এই ভয়ে অনেকেই কর দেন না। এসব ভীতি যে কারণেই আসুক, সেগুলো দূর করতে হবে। ছোটদের জন্য আরও কীভাবে সহজ করা যায়, কীভাবে তারা টাকা দিতে পারে, এটা নিয়ে আমরা বসবো। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করবো। এক কথায় বলতে চাই, করোনায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। আসন্ন বাজেটে ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে, এমন বাজেট চাই। আসন্ন বাজেটে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার ব্যবসায়ীদের যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে শ্রমঘন প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের শ্রমিকদের গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দের পুরো অর্থ ব্যয় হয়নি। এটা অবশ্যই দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেট অবশ্যই সম্প্রসারণমূলক হতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ঘাটতি বাজেট হবে। ঘাটতির মাত্রা জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি হলেও অসুবিধা নেই। তবে ঘাটতির মাত্রা জিডিপির ৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত হবে না।’
আরবিসি/৩১ মে/ রোজি