আরবিসি ডেস্ক : ঈমান শুধু বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ কিংবা আনুষ্ঠানিকতার নাম নয় । ব্যাপক অর্থে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বহুবিধ কর্মের সমন্বয়। মহান আল্লাহ বলেন- পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোন পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহে, পরকালে, মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), গ্রন্থসমূহে এবং নবীগণে, আর ধন সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন-অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্য প্রার্থনাকারীগণকে ও দাস মুক্তির জন্য অর্থ প্রদান করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রুতি দিলে তার পূর্ণ করে এবং অর্থ সঙ্কটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম-সঙ্কটে ধৈর্য ধারণ করে এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকি’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)।
এখানে আল্লাহ্ জানিয়েছেন, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোন পুণ্য নেই। ইসলাম বিশ্বাস ও কর্র্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দান করেছেন। কুরআন কারিমে অন্যান্য স্থানে ঈমানের এ পাঁচটি রুকন ছাড়াও ৬ষ্ঠ রুকনের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- ঈমান হলো এই, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে ও পরকালে এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণে (ভাগ্যে), তার ভাল এবং মন্দে।’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৫)। এখানে ভাগ্য বা তাকদিরকে ঈমানের ৬ষ্ঠ প্রকার হিসেবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, ঈমানের প্রথম রুকন হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- তোমরা কি জান যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান কি?… এ কথা সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরিক নেই এবং মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল।’ (সহীহ বুখারী ১/২৯)। বুখারী শরীফের অপর এক হাদিসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর মহানবীর (সাঃ) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন, ‘ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তা হলো, এ বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমজান মাসের সিয়াম পালন করা, বায়তুল্লাহর হজ আদায় করা।’
তাওহীদ অর্থ এক করা, এক বানানো, একত্রিত করা, একত্বের ঘোষণা দেয়া বা একত্বে বিশ্বাস করা। কুরআন কারিমের অগণিত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মহান আল্লাহকে এক মানা বা তাঁর একত্বের ঘোষণা দেয়ার দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত রাব্ব বা প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে ‘তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ’ বলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইলাহ বা মাবুদ হিসেবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে ‘তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ’ বলা হয়। আরবের কাফিরগণ প্রথম পর্যায়টি বিশ্বাস করত। কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টি অস¦ীকার করত। আল্লাহ বলেন- বল, আসমান এবং জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিযিক দান করেন? কে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির মালিক? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে নির্গত করেন? বিশ্ব পরিচালনা করেন কে? তারা উত্তরে বলবে : আল্লাহ। বল : তাহলে কেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করছ না’ (সূরা ইউনুস : ৩১)।
আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের তাওহীদের অংশ হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর তাওহীদ। অর্থাৎ দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : ওয়া লিল্লাহিল আসমাউল হুসনা, ফাদউ’হু বিহা… এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহ বিকৃত করে বা নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শিগগিরই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে’ (সূরা আরাফ : ১৮০)।
যেহেতু যুগে যুগে কাফিরগণ রব্ব হিসেবে আল্লাহর একত্ব স্বীকার করত, কিন্তু মাবুদ হিসেবে তার একত্ব অবিশ্বাস করত এজন্য তাওহীদের ব্যাখ্যায় কুরআন ও হাদিসে সর্বদা তাওহীদুল ইবাদাত অর্থাৎ ইলাহ বা মাবুদ হিসেবে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয়ার কথাই বলা হয়েছে। ইবাদাত শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা দাস শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবুদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদাত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবুদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় মৌলিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদাত’ বুঝানো হয় অলৌকিক, অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে।
আরবীতে ‘ইলাহাহ’ শব্দটি ‘ইবাদাহ’ শব্দের সমার্থক। কুরআন কারিমের বিভিন্ন কিরাআত বা পাঠে ‘ইলাহাহ’ শব্দটি ইবাদত শব্দের হুবহু সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ইলাহ শব্দের অর্থ হলো মাবুদ বা ইবাদত-কৃত বা উপাস্য। আরবীতে সকল পুজিত, উপাসনাকৃত বা অলৌকিকভাবে ভক্তিকৃত দ্রব্য, ব্যক্তি বা বস্তুকে ইলাহ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ছিল ‘ইলাহাহ’। কারণ কিছু মানুষ সূর্যের উপাসনা করত’ (ইবনুল ফারিস, মু’জামু মাকাইসিল্লুগাহ ১/১২৭)।
এ জন্য সকল নবী রাসূলেরই দাওয়াত ছিল : ইয়া কাওমি’ইবুদুল্লাহ মালাকুম মিন ইলাহিন গায়রুহ- হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন মাবুদ নাই’ (সূরা আরাফ : ৫৯)। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : আমি সকল জাতির কাছে রাসূল বা আমার বাণীবাহক পাঠিয়েছি, যেন তারা আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাগুতকে অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদত করা হয় সবকিছু বর্জন করে’ (সূরা নাহল : ৩৬)। মহানবী (সা.) বলেছেন : ইয়া আয়্যুহান্নাস! কুলু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তুফলিহুন- হে মানুষেরা তোমরা বল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।’ (সহীহ ইবনু খুজাইমা : ১/৮২)।
আবু হুরায়রা (রা.) প্রশ্ন করেন : হে আল্লাহর রাসূল, সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে যে কেয়ামতের দিন আপনার শাফায়াত লাভে ধন্য হবে? উত্তরে তিনি বলেন : আসআদুন্নাস বিশাফাআ’তি ইয়াওমাল কিয়ামাহ মান কালা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ খালিাসান মিন কালবিহি- সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে আমার শাফায়াত লাভে ধন্য হবে সে ওই ব্যক্তি, যে অন্তরে বিশুদ্ধতম বিশ্বাস নিয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’Ñ আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নাই’ এ কথা বলেছে।’ (সহীহ বুখারী :১/৪৯)
তাওহীদের বিশ্বাসই সকল মানসিক ও আত্মিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি দান করে। এ বিশ্বাস মানুষকে মানবীয় পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয় এবং মানুষের মনে এনে দেয় পরিপুর্ণ প্রশান্তি। তাওহীদে বিশ্বাসী ও শিরকে লিপ্ত মানুষের আত্মিক ও মানসিক অবস্থার পার্থক্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন : আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন : এক ব্যক্তির প্রভু অনেক, যারা পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন এবং এক ব্যক্তির প্রভু কেবল একজন : এ দুইজনের অবস্থা কি সমান? প্রশংসা আল্লাহরই নিমিত্ত। কিন্তু এদের অধিকাংশ তা জানে না’ (সূরা যুমার: ২৯)।
আরবিসি/২৮ মে/ রোজি