• শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন

কৃষকের ধানী জমি পুকুরে

Reporter Name / ১৫৮ Time View
Update : রবিবার, ৯ মে, ২০২১

নওগাঁ প্রতিনিধি : কৃষক তনজেব আলী মাঠের তিন বিঘা বোরো ধানের জমিতে পুকুর খননের জন্য লিজ দিয়েছেন। বছরে ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে তিন বিঘায় তার আয় হবে ৬০ হাজার টাকা। তিনি ধান চাষ করে বহুদিন ধরে লোকসান গুনে আসছিলেন বলে দাবী করেন।

শুধু কৃষক তনজেব আলীই নন, ওই মাঠের আরও ৪৪ কৃষক ধান চাষে টিকে থাকতে না পারার হতাশা থেকে তাদের ২০০ বিঘা ধানী জমি তুলে দিয়েছেন মাছ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে। ইতোমধ্যে কৃষকের ওইসব জমিতে খনন করা হয়েছে পুকুর। ফলে মাঠের ২০০ বিঘায় এবছর উৎপাদন হয়নি অন্তত ৬ হাজার মণ ধান। চিত্রটি নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের মাউল মাঠের।
শুধু মাউল মাঠেই নয়, উপজেলার যত্রতত্র আবাদি জমি, বিশেষ করে ধানী জমিতে চলছে পুকুর খননের উৎসব। বর্তমানে মান্দা, পরানপুর, ভারশোঁ, গনেশপুর, কাঁশোপাড়া ইউনিয়নসহ বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের নহলা কালুপাড়া গ্রামের মাঠে বোরো ধানের জমিতে এস্কেভেটর দিয়ে পুকুর খনন করা হচ্ছে। এভাবে আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খনন করায় প্রতিনিয়ত কমছে কৃষি জমি। একই সঙ্গে কমছে ফসলের উৎপাদন। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামি দিনে ‘শস্যভান্ডা’র নামের পরিচিতি হারাবে নওগাঁর মান্দা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, বসতবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কারণে প্রতিনিয়তই কমছে চাষযোগ্য জমি। বর্তমানে মাছ চাষের জন্য ফসলি জমি নির্বিচারে পুকুরে রুপান্তরিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষার পানি জমা হয় এমন বিলগুলোর বুকে খনন হচ্ছে পুকুর। পুকুরগুলোর উঁচুপাড় বর্ষার পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ করে। ফলে বর্ষাসহ শুষ্ক মৌসুমেও পুকুরগুলোর আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি। এতে আশপাশের তিন ফসলি জমিও আর থাকছে না তিন ফসলী। বিলম্বিত হয় রবি ও বোরো চাষ।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, মান্দা উপজেলায় মোট জমির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৭১৯ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ ২৭ হাজার ৮৫১ হেক্টর। জনসংখ্যার অনুপাতে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ শতক। এছাড়া ৮০৫ হেক্টর জমিতে রয়েছে বনাঞ্চল। অবশিষ্ট জমি বিল, জলাশয় ও সরকারি পুকুর। তবে কত হেক্টর জমিতে ব্যক্তিমালিকানার পুকুর রয়েছে এর পরিসংখ্যান উপজেলা মৎস্য অফিস, কৃষি অফিসসহ কোন দপ্তরেই পাওয়া যায়নি।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চলতি খরা মৌসুমের শুরু থেকেই মান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব শুরু হয়। লোকাল প্রশাসন কিছুকিছু এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়ে দন্ড-জরিমানাও করে। এরপরও থেমে থাকেনি পুকুর খনন। ইতোমধ্যে ফসলি জমিতে দুই শতাধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এখনও অব্যাহত রয়েছে খননকাজ। এ কাজের সঙ্গে জড়িত একশ্রেণির অসাধু সিন্ডিকেট বিভিন্ন কৌশলে এসব কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ।

পুকুর খননের জন্য জমির লিজদাতা কৃষকরা জানান, একবিঘা জমিতে ধান চাষ করে পাওয়া যায় ২০ থেকে ২৫ মণ ধান। ধান উৎপাদনে সার-কীটনাশক, হালচাষসহ অন্যান্য খরচ করতে হয়। একই সঙ্গে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অনেক সময় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজার মূল্যের সামঞ্জস্য না থাকায় লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু মাছ চাষের জন্য একবিঘা জমি লিজ দিয়ে ২০ হাজার টাকা পাওয়া যাচ্ছে। এখানে কোনো টেনশন নেই।

মাউল গ্রামের কৃষক সামসুল আলম, আব্দুল কাদেরসহ আরও অনেকে জানান, চলতি বোরো মৌসুম শুরুর আগেই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের মাউল বিলে প্রায় ২০০ বিঘা জমির চারিদিকে পাড় দিয়ে ধানী জমি পুকুরে পরিণত করা হয়েছে। এতে করে প্রত্যেক মৌসুমে ওই বিল থেকে অন্তত ৬ হাজার মণ বোরো ধানের উৎপাদন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে।
কৃষকরা জানান, ‘আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। সেই মাছ উৎপাদনের অজুহাতে ফসলি জমিতে পুকুর খননের হিড়িক চলছে এটা ঠিক নয়। এভাবে পুকুর খননের সুযোগ দেয়া হলে একসময় ফসলি জমি মাত্রাতিরিক্তভাবে কমে যাবে। ধান উৎপাদনের জন্য যদি ফসলি জমি না থাকে তাহলে মাছ দিয়ে তখন কি হবে।’
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২৫ শতক। বর্তমানে তা কমে ১০ শতকে এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় অনুমতি ছাড়াই শ্রেণি পরিবর্তন করে খনন করা হচ্ছে পুকুর। এতে করে দেশে ভবিষ্যতে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে আইনি পদক্ষেপ জরুরি বলেও মনে করেন এ কৃষিবিদ।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোনমি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আব্দুল আলিম বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বসতবাড়ি নির্মাণ, নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন কারণে দিনদিন কমছে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ। এর মধ্যে চলছে অপরিকল্পিত পুকুর খনন, যা কখনোই কাম্য নয়। আগামিতে খাদ্য ঘাটতির সম্মুথীন হবে জাতি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ধান ও মাছের দামের পার্থক্য, মাছচাষ সহজ ও তুলনামুলক লাভবান বেশি হওয়ার সম্ভাবনায় মাছচাষে লোকজন ঝুঁকে পড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র কৃষি জমিতে খনন করা হচ্ছে পুকুর। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ প্রসঙ্গে মান্দা উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) ইমরানুল হক বলেন, সরকারি জমিতে কেউ পুকুর খনন করলে সেক্ষেত্রে দপ্তরের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ব্যক্তিমালিকানার জমিতে পুকুর খনন হলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে কেউ সংক্ষুব্ধ হয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করলে ভালো রায় মিলবে।

আরবিসি/০৯ মে/ রোজি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category