রোজিনা সুলতানা রোজি : করোনা মহামারী ও শুরু থেকেই নানা প্রতিকুলতার মধ্যে এবারো রাজশাহীর গাছে গাছে বেড়ে উঠছে আম। মৌসুমের শুরুতে রাজশাহীতে এবার গাছে গাছে প্রচুর মুকুল এসেছিল। সে তুলনায় গুটি ধরে কম। এরপর কয়েকদফা ঝড়ে পড়েছে অনেক গুটি। তারপরও ঝড়-ঝাপ্টা সামলে গাছে গাছে এখন পরিণত হচ্ছে আম। আগামী মাসের মাঝামাঝিতেই গুটি জাতের আম পাকতে শুরু করবে বলে মনে করছেন চাষিরা।
আম চাষিরা জানান, গত ৩ এপ্রিল মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখীতে রাজশাহীর পুঠিয়া, বাঘা ও চারঘাট উপজেলার প্রচুর আম ঝরে পড়ে। এরপর ৯, ১২ এবং সর্বশেষ ২১ এপ্রিলের ঝড়েও কিছু আম ঝরেছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় বাঘা উপজেলায়। সবগুলো ঝড় গেছে এ উপজেলার ওপর দিয়ে। তবে জেলার গোদাগাড়ী, তানোর, মোহনপুর ও পবা উপজেলায় ঝড়ে আমের তেমন ক্ষতি হয়নি।
এসব উপজেলায় অবশ্য খরায় আমের গুটি ঝরে পড়ে। গত বুধবারের বৃষ্টির পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বাগান ইজারা নেয়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর আগেরবারের মতো আমের উৎপাদন হবে না। তবে এখনও গাছে যে আম আছে তা শেষ পর্যন্ত টিকলে খুব বেশি ক্ষতিও হবে না। আর কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেই আম বেড়ে ওঠে। ঝড়ে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের আমচাষি আরিফুল হক জানান, প্রথম ঝড়েই খুব ক্ষতি হয়েছে। এরপরের ঝড়ে আম ঝরলেও প্রথমদিনের মতো নয়। গাছে এখনও আম আছে। তবে গতবছরের তুলনায় কম। আর ২০ থেকে ২৫ দিন পরই স্থানীয় গুটি জাতের আম পাকতে শুরু করবে।
জেলার পবা উপজেলার বাগধানী গ্রামের আমচাষি মহব্বত আলী বলেন, কয়েকদিন আগেও খরায় আম ঝরে পড়ছিল। গাছের গোড়ায় পানি দিয়েও উপকার পাওয়া যাচ্ছিল না। গত বুধবার বৃষ্টির পর তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। মহব্বত বলেন, ‘এবার এমনিতেই গাছে আম কম।
রাজশাহীর কয়েকটি আমবাগানে গিয়ে চাষিদের গাছে এখনও ওষুধ স্প্রে করতে দেখা গেছে। চাষিরা জানিয়েছেন, ঝড়ে আমে আমে বাড়ি খেয়েছে। আঘাত পাওয়া স্থানে পঁচন ধরার আশঙ্কা আছে। বোঁটা দুর্বল হয়ে গেলে আমটি ঝরে পরতে পারে। সেখানে পোকারও আক্রমণ হবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আমে পোকার উপদ্রবও বাড়বে। পোকার এই উপদ্রব যেন বেশি না হয় তার জন্য কীটনাশক এবং ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে।
বাগানে বাগানে আম বেড়ে উঠলেও চাষিদের মনে শঙ্কার কারণ করোনাভাইরাস। চারঘাটের হলিদাগাছি গ্রামের চাষি হাবিবুর রহমান বলেন, গাছে আম যা আছে তাই দিয়েই না হয় হলো, কিন্তু করোনার কারণেই ভয়ে আছি। লকডাউন থাকলে তো আমের বাজারও ডাউন হয়ে যাবে। আমের গাড়ি পাঠানো গেলেও বাজারে আম কেনার লোক পাওয়া যাবে না। তখন এমনিতেই বাজার পড়ে যাবে। আমরা চাষিরা আমের দাম পাব না। আমে লাভ নাকি ক্ষতি হবে সেটা করোনার ওপরেই নির্ভর করছে।
আম নিয়ে চাষিদের আরও একটি শঙ্কা রয়েছে। আর সেটি হলো আম নামানোর সময়সীমা বেঁধে দেয়া। নিরাপদ, বিষমুক্ত ও পরিপক্ব আম বাজারজাত নিশ্চিত করতে গত কয়েকবছর ধরেই রাজশাহীতে জাতভেদে আম পাড়ার তারিখ নির্ধারণ করে দেয় জেলা প্রশাসন। গতবছর ১৫ মে থেকে সব ধরনের গুটি আম, গোপালভোগ ২০ মে থেকে, রানীপছন্দ ও লক্ষ্মণভোগ বা লখনা ২৫ মে থেকে, হিমসাগর বা খিরসাপাত ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি ১৫ জুন এবং ফজলি ১৫ জুন থেকে এবং সবার শেষে ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা ও বারী আম-৪ নামানোর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল।
বাঘা উপজেলার মীরগঞ্জ এলাকার চাষি সোহাগ আলী বলেন, রাজশাহীতে আমে কোন কেমিক্যাল দেয়া হয় না। আগাম আম পেড়েও পাকানো হয় না। বিষমুক্ত আমই চাষিরা বাজারজাত করে। তারপরও তারিখ বেঁধে দেয়া হয়। এতে কখনও কখনও তারিখের আগেই কোন কোন আম গাছে পেকে যায়, কিন্তু চাষিরা নামাতে পারেন না। এসব আম নামাতে গেলে তাঁদের নানা বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। তাই এবার যেন ঠিকঠাক দিন ঠিক করা হয়।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, কৃষি কর্মকর্তা, ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী, স্থানীয় আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেই আম নামানোর তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তাই এই তারিখ নিয়ে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। এরপরও কৃষির অনেক কিছুই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। প্রাকৃতিক কারণে আম আগে বা পরে পাকতে পারে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, রাজশাহীতে এ বছর ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। গত বছর ১৭ হাজার ৫৭৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। এবার বাগান বেড়েছে ৩৭৩ হেক্টর জমিতে। এ বছর হেক্টর প্রতি ১১ দশমিক ৯ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জেলায় এ বছর মোট দুই লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কেজেএম আবদুল আউয়াল বলেন, ঝড়বৃষ্টি নেই নেই করতে বরতে কয়েকটা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেল। কিছু আম ঝরে পড়েছে সত্য, তবে এতে ক্ষতি খুব বেশি হবে না। কারণ, আম ঝড়-ঝাপ্টা সহ্য করেই শেষপর্যন্ত টিকে থাকে। তবে এবার গতবছরের তুলনায় গাছে আম কম।
আরবিসি/২৭ এপ্রিল/ রোজি