আরবিসি ডেস্ক: ঢাকার গুলশানে এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। পুলিশের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করা হলে বিচারক শহীদুল ইসলাম তা মঞ্জুর করেন।
ঢাকার মহানগর পুলিশের অপরাধ, তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার জাফর হোসেন এ তথ্য জানান। সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান-২ এর ১২০ নম্বর রোডের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের ওই তরুণীর ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে রাত দেড়টার দিকে গুলশান থানায় মামলা করেন ওই তরুণীর বোন নুসরাত জাহান।
মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহানের বিরুদ্ধে ‘আত্মহত্যায় প্ররোচনার’ অভিযোগ আনা হয়। আর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তরুণীর সঙ্গে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির ‘প্রেমের সম্পর্ক’ ছিল। তিনি ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াতও করতেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে সায়েম সোবহান বা বসুন্ধরা এমডির বক্তব্য জানতে পারেনি।
পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল হাসান ফিরোজ বলেন, মুনিয়া ঢাকার একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি কুমিল্লায়; পরিবার সেখানেই থাকে। “তিনি এখানে থেকে পড়াশুনা করতেন। গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকতেন। মাস দুয়েক আগে এক লাখ টাকায় ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। সে সময় দুই মাসের ভাড়া অগ্রিম দেওয়া হয়।” পুলিশ ওই ফ্ল্যাটের সিসি ক্যামেরার ভিডিও এবং মুনিয়ার ব্যবহৃত ডিজিটাল ডিভাইসগুলো জব্দ করেছে বলেও নাজমুল হাসান জানান।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২১ বছর বয়সী মোসারাত জাহান মুনিয়া মিরপুর ক্যান্টনম্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। তাদের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরপুরে; বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান। মামলার বাদী নুসরাত জাহান এজাহারে বলেছেন, দুই বছর আগে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের (৪২) সঙ্গে মুনিয়ার পরিচয় হয়। পরে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় তারা দেখা করতেন এবং মোবাইলে কথা বলতেন। এক পর্যায়ে তাদের ‘প্রেমের সম্পর্ক’ গড়ে ওঠে।
“২০১৯ সালে উক্ত আসামি আমার বোনকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে আসামির পরিবার আসামি ও মুনিয়ার প্রেমের সম্পর্কের কথা জানতে পেরেৃ এক নারীর মাধ্যমে আসামির মা ডেকে ভয়ভীতি দেখায় এবং ঢাকা থেকে চলে যেতে বলে। তখন আসামি আমার বোনকে কৌশলে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়। পরে বিয়ে করবে বলে আশ্বাস দেয়।
নুসরাত জাহানের অভিযোগ, গত ১ মার্চ তার এবং তার স্বামীর এনআইডি ব্যবহার করে ঢাকায় বাসা ভাড়া নিতে মুনিয়াকে প্ররোচিত করেন আসামি সায়েম সোবহান আনভীর। পরে গুলশোনের ১২০ নম্বর রোডের ১৯ নম্বর ভবনের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হয় এবং মুনিয়াকে ‘ফুসলিয়ে’ ঢাকায় নিয়ে আসেন আসামি।
ওই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে আসামির সঙ্গে মুনিয়ার ‘স্বামী-স্ত্রীর মত ছবি’ তুলে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছিল জানিয়ে বাদী এজাহারে বলেন, “আমার বোনের মাধ্যমে আমি জানতে পারি, আসামি আনভীর মুনিয়াকে বিয়ে করে দেশের বাইরে সেটেল করবে। কারণ বাংলাদেশে যদি আসামির বাবা-মা মুনিয়ার সাথে সম্পর্কের কথা জানতে পারে, তাহলে আনভীরকে কিছু করবে না, মুনিয়াকে তার বাবা-মা মেরে ফেলবে।”
এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১ মার্চ থেকে মুনিয়াকে ওই ফ্ল্যাটে রেখে মাঝেমধ্যে সেখানে আসা-যাওয়া করতেন আসামি আনভীর। এর মধ্যে গত শুক্রবার মুনিয়া তার বোনকে ফোন করে বলেন, ফ্ল্যাটের মালিকের বাসায় গিয়ে ইফতার করায়, ছবি তোলায় আনভীর তাকে ‘বকা দিয়েছেন’, কারণ ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী ফেইসবুকে সেই ছবি পোস্ট করেছেন এবং তার এক বান্ধবী সেই ছবি দেখেছেন। সেই বান্ধবী আনভীরের মাকে সব জানিয়ে দেবেন বলে তার আশঙ্কা। মুনিয়াকে ‘বলা’ আনভীরের কথা থেকে উদ্ধৃত করে এজাহারে বলা হয়, “তোমার আর এখানে থাকা যাবে না। আমি ২৭ তারিখ দুবাই যাচ্ছি। তুমি কুমিল্লায় চলে যাও। কারণ আম্মা জানতে পারলে তোমাকে মেরে ফেলবে।”
এরপর ২৫ এপ্রিল মুনিয়া আবার ফোন করে কান্নাকাটি করে জানিয়ে তার বাদী এজাহারে লিখেছেন, আনভীর আর মুনিয়াকে ‘বিয়ে করবেন না’ বলে জানিয়েছেন। “আমাকে (মুনিয়া) চিৎকার করে কান্না করে বলে, ‘আনভীর আমাকে ধোঁকা দিয়েছে’, তিন চারবার বলে, ‘এবং যে কোনো সময় আমার কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তোমরা তাড়াতাড়ি ঢাকায় আস।’”
এজাহারে বলা হয়, নুসরাত জাহান তার আত্মীয়দের নিয়ে সোমবার দুপুরে কুমিল্লা থেকে ঢাকার পথে রওনা হন। আসার পথে মুনিয়াকে বারবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। গুলশানের ওই বাসায় পৌঁছে দরজায় নক করলেও কেউ খোলেনি। ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে ফ্ল্যাটের ইন্টারকমে ফোন করেন মুনিয়ার বোন। পরে ফ্ল্যাটের মালিককে জানানো হলে মিস্ত্রি এনে তালা ভেঙে ঘরে ঢোকেন তারা।
নুসরাত জাহান এজাহারে লিখেছেন, তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার পর তিনি দেখেন, তার বোনের দেহ শোবার ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলছে। পা ‘খাটের উপর লাগানো এবং সামান্য বাঁকানো’ অবস্থায় ছিল। পরে পুলিশ এসে ওড়না কেটে মুনিয়ার মৃতদেহ নামায়। আসামির সঙ্গে মুনিয়ার ছবি, প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে লেখা মুনিয়ার ডায়েরি এবং দুটি মোবাইল ফোন পুলিশ আলামত হিসেবে নিয়ে যায়। আসামির ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায়’ ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সোয়া ৪টার মধ্যে কোনো এক সময় মুনিয়া মারা যান বলে এজাহারে দাবি করেছেন তার বোন নুসরাত জাহান।
আরবিসি/২৭ এপ্রিল/ রোজি