বিশেষ প্রতিবেদক : দেশে স্থাপিত প্রথম জাদুঘর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। সংক্ষেপে বরেন্দ্র জাদুঘর নামে পরিচিত। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক এই সংগ্রহশালাটি রাজশাহী নগরীর জিরোপয়েন্ট থেকে আনুমানিক ৮০০ মিটার পশ্চিমে প্রধান সড়কের উত্তরে হেতেম খাঁ এলাকায় অবস্থিত। বরেন্দ্র অঞ্চলের তৎকালীন জ্ঞানী, গুণী ও পণ্ডিতজনেরা রাজশাহীর নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য ১৯১০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। ১৯১৪ সালে নিবন্ধন লাভ করে এই জাদুঘরটি। শুরুতে জাদুঘরটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত হলেও বর্তমানে এটি পরিচালিত হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে।
কোলাহলমুক্ত পরিবেশে অভিজাত মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা এই জাদুঘরটিতে প্রাচীন মহেঞ্জোদারো সভ্যতার নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে, আবার বাংলার অতীতকে জানতে হলে এই ভবনেই চোখ রাখতে হবে। প্রতিদিন শত শত বিদ্যার্থী, পর্যটক এবং জ্ঞানান্বেষীরা এই প্রাচীন জাদুঘরটির বিশাল ও বৈচিত্রময় সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। অতীতের হাত ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে এই জাদুঘরটি।
জানা যায়, প্রাচীন এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তারা বাংলার ঐতিহ্য, নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করেন। ওই বছর তারা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন। এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। পরে ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বরেন্দ্র জাদুঘরকে এর নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে স্বাধিকার প্রদান করা হয়। একই বছরের ১৩ নভেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের খননকাজ করে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির একক প্রচেষ্টায় পাহাড়পুর থেকে ২৫৬টি নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পরে জাদুঘরটির অস্তিত্ব নিয়ে সংকট দেখা দেয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাদুঘর ভবনটির অর্ধেকাংশ মেডিকেল স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জাদুঘরটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ওই বছরের ১০ অক্টোবর এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে।
৭টি প্রদর্শন কোষ্ঠে ভাগকৃত এই জাদুঘরটিতে আছে ২৫ হাজারের অধিক প্রত্ন নিদর্শন। এখানে আছে ভাস্কর্য শিল্প, বিভিন্ন মুদ্রা, শিলালিপি, পোড়ামাটির ফলক ও মৃন্ময় শিল্প, পাণ্ডুলিপি, চিত্রশিল্প প্রভৃতি। আছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআন, আরো আছে হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, মহেঞ্জোদারো সভ্যতা থেকে সংগৃহীত প্রত্নতত্ত্ব, পাথরের মূর্তি, খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধমূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গামূর্তিসহ অসংখ্য মূর্তি। এ ছাড়াও আছে মুঘল আমলের রৌপ্যমুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্যমুদ্রা।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন পুঁথি প্রজ্ঞা-পারমিতাসহ ৫ হাজার পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরটিতে, যার মধ্যে ৩ হাজার ৬৪৬টি সংস্কৃত আর বাকিগুলো বাংলায় রচিত। পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পর্যন্ত সময় পরিধিতে অঙ্কিত চিত্রকর্ম, নূরজাহানের বাবা ইমাদ উদ দৌলার অঙ্কিত চিত্র এখানে রয়েছে। জাদুঘরটিতে ১৫ হাজার গ্রন্থ সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থশালা রয়েছে। যেখানে আছে ইলিয়াড, শেক্সপিয়ারসহ বিভিন্ন বিখ্যাত গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ।
এ ছাড়াও আছে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র তলোয়ার, বন্দুক, ছোট কামান। আছে আবহমান বাংলার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, আদিবাসীদের ব্যবহার্য বিভিন্ন অলংকার ও জাতীয় চার নেতার মধ্যে অন্যতম শহীদ কামারুজ্জামানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র।
জাদুঘরটির পরিদর্শকদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে জাদুঘরটি বন্ধ আছে। কেবল বিশেষ কোনো দর্শনার্থীরা এলে জাদুঘরটি পরিদর্শনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। বন্ধ থাকলেও প্রতিনিয়ত জাদুঘরটি পরিষ্কার করা হয়। করোনাকালের পূর্বে জাদুঘরটি পরিদর্শনে প্রতিদিন আট শ থেকে ১ হাজার দর্শনার্থী আসত, তবে গ্রীষ্মকালের তুলনায় শীতকালে বেশি দর্শনার্থী ভিড় জমাত এই জাদুঘরটিতে। জাদুঘরটি বৃহস্পতি ও শুক্রবার ব্যতীত গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং শীতকালে ১ ঘণ্টা কমিয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক এ আর এম আবদুল মজিদ জানান, জাদুঘরটির প্রত্নসম্পদ সংগ্রহের পরিমাণ ও গুণগতমান অবাক করার মতো। জাদুঘরটিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন মূর্তিগুলো দেখে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হয়। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে জাদুঘরটিতে। দেশি-বিদেশি শিক্ষক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ার সুযোগ পান এখানে। এমন সব অসাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে চোখ বোলাতে প্রতিদিন গবেষণা জাদুঘরটিতে আসেন হাজারো দর্শনার্থী। দেশের এবং বিভিন্ন দেশের গবেষকরাও এখানে আসেন এই উপমহাদেশের ঐতিহাসিকতা জানতে।
আরবিসি/০৬ এপ্রিল/ রোজি