• শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৮ পূর্বাহ্ন

রক্তে লাল ছিলো মতিহারের সবুজ চত্ত্বর

Reporter Name / ১৯৭ Time View
Update : শুক্রবার, ২৬ মার্চ, ২০২১

বিশেষ প্রতিবেদক : মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে সময় প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে বুকে অসীম সাহস নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দেশব্যাপী অতর্কিত হামলায় বাদ পড়েনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও। এর আগে ১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জোহার মহান আত্মত্যাগের চেতনা অণুপ্রাণিত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবর্স্তরের মানুষকে। এরই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষক এবং অন্তত ৩০ জন ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধে কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহীতে সক্রিয় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হয়। ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিপুল অংশ শহরে প্রবেশ করে। ১৩ এপ্রিল ভোরে পাক সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে আর্টিলারি ফায়ার ও জঙ্গী বিমানের গোলাবর্ষণ অব্যাহত রাখে। তারা জোহা, জিন্নাহ (বর্তমান শেরে বাংলা) হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংস করে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার। হাবিব ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরিতে লুটতরাজ চালায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সূত্রে জানা যায়, মুক্তিয্দ্ধু চলাকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে শাহাদতবরণ করেন রাবির ৩ শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয় দখলের পরদিন ১৪ এপ্রিল সংস্কৃত বিভাগের শহীদ অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। ১৫ এপ্রিল গণিত বিভাগের রিডার শহীদ অধ্যাপক হবিবুর রহমানকে সেনাবাহিনী তুলে নেয়। তাঁর হদিস এখনও মেলেনি। মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মীর আবদুল কাইয়ুমকে ২৫ নভেম্বর জীবন্ত কবর দেয়া হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অকথ্য নির্যাতন ভোগ করেছিলেন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবর রহমান।

এছাড়াও শহীদ হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী প্রশাসনিক ভবনের নৈশপ্রহরী আবদুর রাজ্জাক, স্টেনো টাইপিস্ট শেখ এমাজউদ্দিন, উচ্চমান সহকারী এসএম সাইফুল ইসলাম, প্রকৌশল দফতরের কর্ম সহযোগী মো. কলিম উদ্দিন, সুইপার মোহনলাল, পরিবহন শাখার ড্রাইভার আবুল আলী, কাঠমিস্ত্রি শফিকুর রহমান, প্রহরী নূরু মিঞা, উপাচার্য অফিসের জরুরি পিয়ন মোহাম্মদ ইউসুফ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের পিয়ন মো. ওয়াজেদ আলী, প্রহরী মো. আফজল মৃধা, অর্ডালি পিয়ন ওয়াহাব আলী, বেয়ারা আবদুল মালেক, কিউরেটর মনছুর আহমদ খান, প্রহরী হোসেন আলী।

মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভূমিকাও ছিল অসামান্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল মান্নান আখন্দ, শাহজাহান আলী, বাংলা বিভাগের আমীরুল হুদা জিন্নাহ, এমএসসি ছাত্র গোলাম সারওয়ার খান সাধন, রসায়ন বিভাগের প্রদীপ কুমার রাহা, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মোহাম্মদ আলী খান, পদার্থবিদ্যা বিভাগের ছাত্র মিজানুল হক।

রাবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি দখলে নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় পাক বাহিনী। ৯ মাসে অন্তত ৪ হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয় এখানে। নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হত শহীদ শামসুজ্জোহা হল। যার প্রমাণ এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গণকবর। গবেষকদের ধারণা, পদ্মা নদীর তীর জুড়ে রয়েছে আরও গণকবর, যা এখনও চিহ্নিত করা হয়নি।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলের আধা-মাইল দূরে আবিষ্কৃত হয় একটি গণকবর। সেটি খনন করে পাওয়া গিয়েছিল সহস্র মানুষের মাথার খুলি ও নরকঙ্কাল। এছাড়াও মিলেছে মানুষের ব্যবহৃত হাতঘড়ি ও কলম, টুপি, এক ও দশ টাকার নোট মিলে তিনশো টাকা, চাবির রিং, সাইকেলের চাবি, কানের দুল, সিগারেটের লাইটার, মানিব্যাগ, কাজলের টিউব, ওড়না, পাথর বসানো আংটি, চিরুনি, মহিলাদের কার্ডিগান ইত্যাদি। পরবর্তীকালে এগুলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি-স্মারক, ভাস্কর্য, ম্যূরাল প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩ শিক্ষকের নামে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টি হল ও আন্তর্জাতিক ডরমেটরি। এছাড়া শহীদদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বধ্যভূমিতে ১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি স্মৃতিফলক উন্মোচন করা হয়। রাতের আঁধারে ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা স্মৃতিফলকটি ভেঙে ফেললে পুনরায় ১৯৯৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করা হয়।
রাকসু নেতারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিত্তি করে গড়েছেন ‘সাবাস বাংলা’ ভাস্কর্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন চত্বরে অবস্থিত এই ভাষ্কর্যটির স্থপতি নিতুন কুণ্ডু। ভাষা শহীদদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি গড়া হয়েছে। এই শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই রয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি ও ঐতিহাসিক উপকরণ সংবলিত দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ এ জাতি কখনো ভুলবে না। ভুলবে না রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে মতিহারের এই সবুজ চত্বর।

মুক্তিযুদ্ধে নিজ এলাকায় অংশ নিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত ও বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রাবির অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এক বিরাট ভূমিকা ছিলো। সেটা ড. জোহার আত্মত্যাগই প্রমাণ করে। তাঁর আত্মত্যাগের মাধ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাধীনতার স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল।
মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে রাজশাহী শহরে প্রায় প্রতিদিন মিছিল হয়েছে। সেই উত্তাল আন্দোলনে রাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিলো অতুলনীয়। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন রাবি শিক্ষক জুলফিকার মতিন, মাজহারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, গোলাম মোর্শেদ, খন্দকার মনোয়ার হোসেনসহ আরও অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবুর রহমান দেশে সংখ্যালঘুদের হত্যার প্রতিকি প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের নাম পরিবর্তন করে দেবদাস রাখেন। অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী শহীদ হন। এছাড়াও অনেকে অমানবিক নির্যাতন শিকার হয়েছিলেন। সবমিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জোরালো ভূমিকা ছিলো বলে জানান তিনি।

আরবিসি/২৬ মার্চ/ রোজি

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category